- বইয়ের নামঃ খেলারাম খেলে যা
- লেখকের নামঃ সৈয়দ শামসুল হক
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. বাসাটা খুঁজে পেল বাবর
দু একজনের কাছে জিগ্যেস করতেই বাসাটা খুঁজে পেল বাবর। কাজী সাহেব তাকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন।
আরে আপনি! কখন এলেন? কীভাবে এলেন? আসুন, আসুন।
চলে এলাম। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ এমন কী দূর! গাড়ি চালিয়ে চলে এলাম।
পরীক্ষণেই বাবরের মনে হলো আসবার কারণ কিছু না বললে উপস্থিতিটা শোভন হচ্ছে না। তাই সে যোগ করল, এখানে একটা কাজ ছিল।
দুহাত নেড়ে কাজী সাহেব বলে উঠলেন, কাজ পরে হবে, আগে বিশ্রাম করুন। কতদিন পরে আপনার সঙ্গে দেখা, আগে ভাল করে গল্প-টল্প করি।
আজ সেরেই এসেছি। এখন আর কাজ নেই। ভাবছি আজই ঢাকায় ফিরে যাব।
যেতে দিলে তো! কাল যাবেন।
কাল?
হ্যাঁ কাল। অসুবিধো কী!
না, অসুবিধে কিছু নেই।
আলাদা বিছানার ব্যবস্থা আছেই। শুধু পেতে দিলেই হলো। একটু বসুন, ভেতরে খবর দিয়ে আসি। সিগারেট খান। আপনার তো এ ব্ৰ্যাণ্ড চলে না বোধহয়। আচ্ছা, আমি এক্ষুণি আনিয়ে দিচ্ছি।
সে-কী! না, না।
আপনি বসুন তো। চা না কফি? দুটোই আছে।
চা।
কাজী সাহেব ভেতরে চলে গেলেন। বাবর পা জোড়া সামনে ঠেলে আরাম করে বসল। কয়েক ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে পা যেন জমে গিয়েছে। মাথায় কয়েকটা চুলের গোঁড়া ব্যথা করছে, পেকেছে বোধহয়। বয়স তো কম হলো না। গত মার্চে আটত্রিশ পেরিয়ে উনচল্লিশে। চুল উঠতেও শুরু করেছে কিছু কিছু। পরাজিত সৈন্যদলের মত কপাল থেকে ক্ৰমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে তারা। গত সপ্তাহে মেকাপম্যান কামাল তার মুখে রং লাগাতে লাগাতে বলছিল, একটু যত্ব নিন স্যার। চুলের গোঁড়ায় কালো পেন্সিল বুলিয়ে আর কতকাল চালাবেন? গত সপ্তাহে তার টেলিভিশন প্রোগ্রামটা বেশ ভাল হয়েছিল। সবাই খুব প্ৰশংসা করেছে। কাগজেও লিখেছে। প্রোগ্রামটা কি লতিফা দেখেছে? এ বাসায় ঢোকার আগে দেখা উচিত ছিল বাড়ির মাথায় এন্টেনা আছে কি-না। ময়মনসিংহে তো টেলিভিশনের ছবি ভালই আসে সে শুনেছে। কী বোকা সে! এতক্ষণ তার চোখেই পড়েনি টেলিভিশন সেটটা। বসবার ঘরে এক কোণায় স্যাতস্যাতে আঁধারিতে কার্পেটের ওপর সামনের দুপা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেটটা। তাহলে প্রোগ্রামটা লতিফা নিশ্চয় দেখেছে।
লতিফা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। পরনে কালো পাজামা, শাদার ওপরে কালো সবুজ বর্ডার আঁকা কামিজ। লতিফার সতের সুন্দর একজোড়া স্তন নিঃশব্দে ওঠানামা করছে, প্ৰায় বোঝা যায় কী যায় না।
নিঃশব্দে হাসল বাবর। কিন্তু লতিফা হাসল না। বাবর তখন একটু অপ্রতিভ হলো।
একদৃষ্টে বড় চোখ মেলে তাকিয়ে আছে তার দিকে লতিফা।
কাজী সাহেব এসে মেয়েকে বললেন, যা চা-টা নিয়ে আয়।
লতিফা চলে গেল।
একটা চেয়ার টেনে জুৎ করে তার সামনে বসলেন কাজী সাহেব। বললেন, আজ তো যাওয়া হবে না। কালও যেতে দিই কি-না সন্দেহ।
কাল না গেলে অসুবিধে হবে খুব।
কী এমন অসুবিধে? আমাদের মত তো চাকরি করতে নেই আপনার।
তা নেই। সত্যি।
বেশ আছেন। আপনার প্রোগ্রাম মাঝে মাঝে টেলিভিশনে দেখি! খুব ভাল লাগে। চমৎকার হয়।
ধন্যবাদ।
শুধু টেলিভিশন নিয়েই আছেন, না অন্য কিছু?
ব্যবসা আছে।
কীসের?
ইনডেনটিং। ভাবছি, আমিও চাকরি থেকে রিটায়ার করে একটা ব্যবসা-ট্যাবসা করব। বড় ছেলেটা আর্মিতে এখনও সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট। তারপরে লতিফা। ওর বিয়েটা দিলেই থাকে আরেক ছেলে।
আপনার আর চিন্তা কী তবে? বেশ গুছিয়ে এনেছেন।
কই আর? আপনার ছেলেমেয়ে কটি?
বাবর অবাক হলো কাজী সাহেব জানেন না যে সে বিয়েই করেনি। লতিফার একবার কলেজের ছাত্রীদের প্রোগ্রাম করতে টেলিভিশনে এসেছিল, সেখানে আলাপ। তখন ঢাকায় ছিলেন কাজী সাহেব। তারপর বদলি হয়ে এলেন ময়মনসিংহে। ঢাকার বাড়িতে বেশ কয়েক দিন গিয়েছিল বাবর। দু একবার রাতে খেয়েছেও। না, সেই আলাপে বাবরের নিজের কথা কিছু ওঠেনি। বাবরকে প্ৰায় চল্লিশ ছুঁই ছুঁই দেখে কাজী সাহেব ধরেই নিয়েছেন তার সংসার আছে।
বাবর মিথ্যে করে বলল, ছেলেমেয়ে দুটি।
তবে যে লতিফার কাছে শুনেছিলাম তিনটি।
বাবর ভাবল, দুষ্ট মেয়ে, কীভাবে মিথ্যে কথা বলেছে দেখ। মুখে সে বলল, ভুল করেছে, এক ছেলে এক মেয়ে।
লতিফা আপনাকে কিন্তু খুব শ্রদ্ধা করে। বলে বাবর চাচার মত মানুষ হয় না।
বাড়িয়ে বলে।
কী যে বলেন। আপনারা হলেন আমাদের গৌরবের বস্তু। আর মেয়েকে আমি আজীবন সেই শিক্ষাই দিয়েছি, মানীজনকে সম্মান দেওয়া। সতের বছর বয়েস হলে কী হবে লতিফার, বুদ্ধিতে, বিবেচনায়, নিজের মেয়ে বলে বলছি না, যে কারো সাথে পাল্লা দিতে পারে। আমি জানি। এবার তো আই.এ দিল।
হ্যাঁ, দিয়েছে। ভাবছিলাম বি.এ পর্যন্ত পড়াব।
তা কী হলো?
একটা বিয়ের সম্বন্ধ এসে গেল।
বিয়ে দিচ্ছেন লতিফার?
অবাক হয়ে গেল বাবর। এজন্যেই কি তাকে কোনো খবর না দিয়ে ঢাকা থেকে চলে এসেছে লতিফা? ওভাবে তার হঠাৎ অন্তর্ধানের কোনো কারণ খুঁজে না পেয়েই বাবরের এতদূর আসা। আসার ঝুঁকিটাও কম ছিল না। যদি কাজী সাহেব সহৃদয় ব্যবহার না করেন? যদি তিনি কিছু সন্দেহ করে বসেন? কিম্বা লতিফাই যদি কঠিন হয়?
লতিফা চা নিয়ে এলো। চায়ের সঙ্গে নানা রংয়ের পাঁপড় ভাজা।
ভাল আছেন বাবর চাচা?
তার অপূর্ব সেই উজ্জ্বল মুখখানা সৃষ্টি করে লতিফা বলল। বলে মাথা কাৎ করে চা বানাতে লেগে গেল। কোনো কিছুতে মনোযোগ দিলেই লতিফার মাথাটা কাৎ হয়ে আসে। ভঙ্গিটা বাবরের ভারি চেনা।