আচ্ছা, কথা দিলাম।
বলুন লিমেরিকটা।
এক রূপসী বাড়ি তেনার সুদূর টিটিকাকা—
উড়ে এলেন এয়ার মেলে মস্ত খামে ঢাকা।
পিয়ন দিল বসিয়ে ছাপ।
বলল মেয়ে, বাপরে বাপ,
তলিয়ে গেল প্যারিস রোম, করল ফতে ঢাকা।
জাহেদা চোখ কালো করে বলল, এর মধ্যে খারাপ কিছু নেই তো?
বাবাব হাসল রহস্যময় ভাবে।
তার মানে, আছে?
থাকলেই বা। যখন কেউ কারো এই রকম কাছে হয় তখন খারাপ বলে কিছু থাকে না, থাকতে পারে না। সব ভালো, সব সুন্দর। সব কিছুর ভেতর দিয়ে তারা একটা কথাকেই ফুটিয়ে তোলে। সেটা হচ্ছে, আমরা আমাদের।
জাহেদা কয়েক মুহূর্ত পর বলল সত্যি, আপনার কথা আমি কিছু বুঝতে পারি না। ঠাট্টার মধ্যে হঠাৎ গুরুগম্ভীর কথা বলেন, বলেন সেই ঠাট্টার সুরেই। আবার পাদ্রীদের মত গলায় এমন কথা বলেন যা আসলে রসিকতা।
আসলে কী জান, জীবনে সিরিয়াস হয়ে দেখেছি, কিছু পাইনি। আবার যখন সেই খোলসটা ছেড়ে ফেললাম, দেখি সব আমার হাতে।
তার মানে আপনি এখন সিরিয়াস নন?
একপলক জাহেদাকে দেখল বাবর। কথাটার মৰ্মাৰ্থ বুঝতে চেষ্টা করল। বুঝে দেখল, একটু আটকে ফেলেছে তাকে মেয়েটা। বাবর তখন তার বহু ব্যবহৃত অস্ত্রটা আবার প্রয়োগ করল–হাসল। বলল, তোমার কী মনে হয়?
জাহেদা চুপ করে রইল।
বাবর জানে কী এখন বলতে হবে তাকে। কুটনৈতিক মিশনের নিপুণ কোনো সদস্যের মত উচ্চারণ করল, সত্যি বলতে কী আগে ছিলাম না, কিন্তু কাল সন্ধে থেকে হয়েছি। কখন জান? যখন তুমি গায়ে পুলওভার চাপিয়ে পা ক্রস করে বসলে সেই তখন কোথা থেকে কী হয়ে গেল, তোমাকে নতুন করে দেখলাম। সে দেখার বিস্ময় আর কাটল না। ওভাবে কেন বসলে তুমি? তা হলে তো কিছু হতো না।
আমি কিছু ভেবে তো বসিনি। পা ক্রস করে ছিলাম। তাই জানতাম না। আপনি বলছেন তবু মনে করতে পারছি না।
আকাশ কি জানে সে রঙ্গিন হয়ে আমাদের রঙ্গিন করে। না মনে রাখে।
জাহেদার মুখটা চিকচিক করে উঠল।
বাবর গাড়ি থামিয়ে নামল। বলল, এটা মহীগঞ্জ। এক সময়ে, সে অনেক আগে রংপুরের প্ৰধান এলাকা ছিল এইটে। দাঁড়াও তাজহাটের রাস্তাটা কাউকে জিগ্যেস করি।
দুদিকে সারি সারি গুদাম ঘর, বাসা ভাঙ্গা দালান। মনে হয় মানুষ ছিল কিন্তু কোনো মহামারীর ভয়ে পালিয়ে গেছে। যাদের দেখা যাচ্ছে তারাও যেন নিঃশব্দে চলাফেরা করছে, এপার থেকে ওপারে মিলিয়ে যাচ্ছে দ্রুত। ঘুঘু ডাকছে দূরে ঘন ঝোঁপের ভেতর থেকে। পরাজয়ের একটা বিষণ্ণ বর্ণের প্রলেপ চারদিকে। জাহেদার মনে হলো, অবিকল একটা গোলডরাশ শহরের মত, আমেরিকায়, ছবিতে দেয়া, সোনার লোভে মানুষ গড়েছে এবং ফেলে চলে গেছে যেখানে সোনা আছে। মনটা খুব খারাপ করে উঠল তার। বাবর ফিরে এলো। খুলে রাখল জ্যাকেট।
যা গরম লাগছে। আরো খানিকটা যেতে হবে, বলেই অবাক হয়ে গেল বাবর। শুনল জাহেদ আপন মনে বিড়বিড় করে কী যেন বলে চলেছে।
কী বলছি জাহেদা?
ম্লান হাসল মেয়েটা। তাকে সুদূরের মনে হলো।
বলবে না আমাকে?
কী শুনবেন সব ছেলেমানুষী।
তবু।
টেবল পড়ছিলাম। ফোর থ্রিজা টুয়েলভ; ফোর ফোরজা সিক্সটিন; ফোর ফাইভজা টুয়েন্টি।
হঠাৎ নামতা কেন?
এমনি। এমনি মাঝে মাঝে বলি। ভাল লাগে। ফোর সিক্সজা টুয়েন্টি ফোর, ফোর সেভেনজা টুয়েন্টি এইট। কই চলুন।
যাচ্ছি।
বাবর থমকে গিয়েছিল। একটা নতুন খবর শুনেছে যেন। নামতা পড়তে ভাল লাগে। আশ্চর্য! সংখ্যার কী সম্মোহনী শক্তি! ঘুম না এলে একশ থেকে উল্টো দিকে গুণতে হয়। জাহেদার মন কি খুব বিক্ষিপ্ত এখন?
গাড়ি সচল হয়ে উঠল। বলল, হোস্টেলের জন্যে ভয় করছে?
নাহ। যা হবার হবে। ওসব ভেনে; আর মন খাবাপ করতে চাই না।
বাবর হাসল। বলল, জানি, এই একদিনে অনেক বয়স বেড়ে গেছে তোমার। তুমি বড় হয়ে গেছ।
হঠাৎ ব্রেক করল বাবর। জাহেদা প্ৰায় চেঁচিয়ে উঠল, কী হলো?
ঐ দ্যাখ।
সমুখে একটা কালো অতিদীর্ঘ সাপ মন্থর গতিতে এপার থেকে ওপারে যাচ্ছে। আতঙ্কে পাথর হয়ে রইল জাহেদা। বাবর সেই সাপটার দিকে তাকিয়ে রইল সম্মোহিত স্মিতহাস্যে। ধূলায় তার দেহের দাগ পড়ে যাচ্ছে। এই যে বাঁ দিকের শটি বনে ঢুকাল। ধীরে ধীরে ঢুকে গেল তার রাজকীয় দেহটা। লেজের তাড়নায় ফট ফট করে শব্দ হতে লাগল শটি বনে। তারপর শব্দটাও মিলিয়ে গেল। তখন শুধু শূন্য সংবলিত এক নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে লাগল।
জাহেদা জিগ্যেস করল, কী সাপ?
গোখরা। পৃথিবীর ভীষণতম গোখরা এই অঞ্চলে দেখা যায়। এদের যে বিষ তার এত তীব্র ক্রিয়া হয় যে–
দোহাই। দুহাতে মুখ ঢাকল জাহেদা। চুপ করুন।
একটা নিয়ম আছে জাহেদা। সাপ দেখলে আশেপাশের গেরস্তকে খবর দিয়ে যেতে হয়। আমি গায়ের ছেলে তো। ওটা মানি। বলে সে গাড়ির দরোজা খুলতে গেলে জাহেদা খাপ করে হাত টেনে ধরল তার। না, আপনি যেতে পারবেন না।
থরথর করে কাঁপছে জাহেদার হাত নোখগুলো বসে গেছে। বাবরের হাতে। কয়েকটা স্তব্ধ মুহূর্ত তারা তাকিয়ে থাকল একে আরেকজনের চোখে। তারপর হঠাৎ বাবর তাকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট রাখল অত্যন্ত কোমল করে। পরে মুখটা সরিয়ে কানের লতির উপর ছুঁইয়ে বলল, না, যাব না। তুমি যদি বল যাব না।
গাড়ি ফিরিয়ে নিল বাবর। বাঁ হাতে জাহেদার ডান হাতটা ধরে গাড়ি চালাতে লাগল সে। জাহেদা নীরবে নিজেকে সমৰ্পণ করে বসে রইল শূন্য চোখে দুপুরের রোদজ্বলা শালবনের রাস্তার দিকে।
সারা রাস্তায় আর একটা কথাও হলো না। সারা রাস্তা সেই রাজকীয় সাপটা এপার ওপার করতে লাগল। অলস মন্থর গতিতে সারাক্ষণ। জাহেদা খোদিত একটা মূর্তির মত একভাবে বসে রইল। তারপর ক্রমশ যখন শহরে ঢুকল তারা, তখন জীবনের লক্ষণ দেখা গেল তার ভেতরে। একটা নিঃশ্বাস পড়ল। একটা হাত স্থান বদল করল। একটা পা স্যান্ডেল সন্ধান করল।