- বইয়ের নামঃ কয়েকটি মানুষের সোনালি যৌবন
- লেখকের নামঃ সৈয়দ শামসুল হক
- প্রকাশনাঃ অনন্যা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. বাবা শখ করে নাম রেখেছিলেন রজনী
কয়েকটি মানুষের সোনালি যৌবন
বাবা শখ করে নাম রেখেছিলেন রজনী। গায়ের রং ছিল ভোরের কেবল সূর্য উঠতে থাকা অন্ধকারের মতো, ওরই মধ্যে যেন একটুখানি দীপ্তির আভাস। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে সেই রং তার সারাটা মুখে এমন এক সারল্য এনে দিয়েছিলো, যেন অখণ্ড এক মমতার ছবি চোখে দেখা যাচ্ছে। সেই মেয়ে, সেই রজনী, একুশ বছরের বিপজ্জনক বয়সে ঘর পালাবে কেউ ভাবেনি।
কেউ না। রজনী নিজেও না। মানুষ তো তার নিজের সব কথা নিজে জানতে পারে না। রজনীই বা তার ব্যতিক্রম হবে কেন?
একদিন দুপুরে গেল কলেজে। তিনবার আই, এ, ফেল করবার পর চতুর্থ বারের মতো পড়া চলছিল। আর আই, এ পাশ না করলে যে আজকাল ভাল বর পাওয়া যায় না এ সত্যটা বাড়ি থেকে পাঁচনের মতো দুবেলা তাকে গেলানো হচ্ছিল। আজকাল বাবা যখন ডাকেন রজনী বলে সে ডাকে আদরের আভাস মাত্র থাকে না। সে যে ভাগ্যহীনা, সংসারের গলায় মশলা পেষা পাথরের মতো দুর্বহ-ভার, সেই তিক্ততাটুকু ফুটে বেরোয়।
সেদিন রজনী গেল কলেজে। কলেজ থেকে সন্ধ্যের প্লেনে সোজা করাচি।
একা নয়। সঙ্গে একজন। রজনীদের দুবাসা পরের পুরোনো দোতলার মেজ ছেলে মহসিন। লেখাপড়া প্রায় কিছুই না করে ডা ডা করে ঘুরে বেড়াচ্ছিল সুদর্শন চেহারাটাকে মূলধন করে। একদিন মায়ের কাছ থেকে হাজার দুয়েক টাকা পাওয়া গেল। মা বললেন, ব্যবসা কর, কিছু একটা কর, নইলে আমি আত্মঘাতী হবো। সে টাকাই হলো কাল। দুহাজার টাকা মহসিনের কাছে মনে হলো কুড়ি হাজার টাকার মতো। রজনীকে সে ভালবাসত। আর তিনবার আই, এ, ফেল করা, সংসারে সবার কাছে সংকুচিতা রজনী মহসিনের মতো সুদর্শন একজনের কাছ থেকে হৃদয়ের পরম প্রশ্রয় পেয়ে মনে মনে হৃদয়টাকেই তার পায়ের তলায় সমর্পণ করেছিল। সেই তাকে নিয়ে মহসিন ঝাঁপিয়ে পড়ল সংকেতহীন ভবিষ্যতের খাদে।
কিছুদিন থেকে রজনী তার বুকের মধ্যে শুনতে পেত দুয়ার ভাঙ্গার আহ্বান।
শুনতো, শুনে শিউরে উঠতো। মহসিন বলত, আমি একদিন আসবো, ঝড়ের মতো তোমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবো।
ছোটবেলায় ইতিহাসে পড়া পৃথ্বি-রাজ সংযুক্তার গল্প আর সেই সঙ্গে আঁকা একখানা ছবি চমক দিত রজনীর মনে। সে দেখতে পেত, ঠিক ছবিতে যেমন আঁকা, মহসিন ঘোড়ায় চড়ে কোলসাপটা করে তাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে। তখন তার ভয় করত, কিন্তু ভাল লাগত। ফুলের গন্ধ পেত রজনী। চোখে আলো দেখত। মানুষের কোলাহল শুনতে পেত। মহসিনের সঙ্গে তার বিয়ের রাতটা খণ্ড খণ্ড ছবিতে জীবন্ত হয়ে উঠতো। আনন্দে, উদ্বেগে, অন্ধকার ঘরে বালিশ বুকে চেপে নিঃসাড় হয়ে পড়ে থাকত রজনী।
রজনীর পিঠে একদিন মার পড়েছিল। মহসিনের একটা চিঠি পড়েছিল বাবার হাতে। বাসার চাকর ছোঁকরাটি ফিরছিল বাজার করে। তার থলের মধ্যে চিঠিখানা পুরে দিয়েছিল মহসিন। বলেছিল, বুবুর হাতে বাজারের থলে দিবি।
কিন্তু তা আর হলো না। রজনীর বাবা ছিলেন বারান্দায়। বাজার দেখবার জন্যে চাকরটার হাত থেকে থলে নিয়ে উপুড় করতেই দিব্যি ভাঁজ করা চিঠি বেরুলো। পড়লেন। এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মধ্যে ঢুকে টুবুলের আঁক কষা স্কেল দিয়ে মারলেন রজনীকে।
রজনীর পিঠ লাল হয়ে উঠেছিল। ব্যথা করছিল। খানিকক্ষণ পর ব্লাউজটা শরীরের সঙ্গে টেনে ধরেছিল কাঁচা রক্ত শুকিয়ে গিয়ে। তিন দিন গেল না কলেজে। সেই তিনটে দিন মহসিন বাসার চারপাশে ঘুরঘুর করল। এবং অবশেষে সেই চাকর ছোঁকরার মুখ থেকেই শুনলো আদ্যোপান্ত ঘটনা। শুনে প্রথমে সরে গেল রজনীদের বাসার ত্রিসীমা থেকে। রজনীর বাপের চোখে পড়াটা বোধহয় মধুর হবে না, আর এ তিনদিনে যে তাঁর চোখে আদৌ পড়েনি সেজন্যে ভাগ্যতারাকে ধন্যবাদ দিল। পালিয়ে পালিয়ে কী ভাবল কে জানে, প্রায় দিন দশেক পর রজনীকে যখন গলির মোড়ে কলেজ ফেরত পাওয়া গেল তখন মহসিন বলল, বাপ না ডাকাত। বোলো তোমার বাপকে, আমার মতো জামাই পেলে ধন্য হয়ে যাবে।
রজনী বলল, বাবা তোমার কাছে বিয়ে দিলে তো।
কেন? না দিক তো বয়েই গেল। তুমি চলে আসবে, বাইরে বিয়ে হবে। আজকাল কত হচ্ছে। তাছাড়া খরচাপাতিও নেই। বরং আজকাল বাপ মা তাই চাচ্ছে, তুমি খোঁজ নিয়ে দেখ।
অসম্ভব!
কী অসম্ভব?
সে পারবো না।
কেন? বাহ।
কক্ষনো না। ততক্ষণে বাসা প্রায় দেখা যাচ্ছে। মহসিন দাঁড়িয়ে রইল। রজনী মাথা নিচু করে বই খাতা কোলের পরে অদল বদল করতে করতে বাসায় গিয়ে ঢুকলো। তারপর সোজা বাথরুমে। সেখানে বসে বসে ভাবলো মহসিনের কথা। রজনী খানিকক্ষণ কাঁদলো। আবছা করে তার মনে পড়ল দুএকজন বান্ধবীর কথা, একটা ভালো মোটর গাড়ি কবে দেখেছিল সেটা, কবে একদিন রজনী কলেজ থেকে এসে দেখে ঢাকা তার তরকারি বেড়ালে খেয়েছিল সেই কথা। এইসব বিচ্ছিন্ন ছবিগুলো কারণহীন এসে ভিড় করলো এবং তাকে কাঁদালো!
বাড়ি পালানোটাও অদ্ভুত। কলেজে ঢুকতে যাবে, দেখে গেটের সামনে মহসিন দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে। তাকে দেখেই গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলল, চল, তোমার সাথে কথা আছে। এবং ভালো করে কিছু বোঝা বা বলার আগেই রজনী দেখে কখন মহসিনের সঙ্গে এক রিকশায় উঠে বসেছে সে। রিকশা চলছে মেডিক্যাল কলেজের সমুখ দিয়ে। অত বড় দালানে কয়েকশ লোক একসঙ্গে শুয়ে রোগেব যন্ত্রণায় কাত্রাচ্ছে, কী মারা যাচ্ছে এই উপলব্ধিটা রজনীর সেদিন হয়েছিল আর জীবনের প্রতি একটা আচমকা বৈরাগ্য এসে গিয়েছিল।