ফিরে এসে সেলিম বলল, নারে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ভারি সুন্দর হয়েছে তোর মেয়েটা। কার চেহারা পেয়েছে বলতো?
ওর মায়ের।
তোর চোখই নেই। অবিকল তোর মত হয়েছে দেখতে। কেবল রংটা ওর মায়ের।
তার মানে, বলতে চাস, আমি কাল?
কাল ফর্সা দিয়ে এখন আর কী করবি?
কেন, বিয়ে করেছি বলে চান্স আর নেই নাকি?
তোদের শুধু মুখে মুখে। চিনিস এক অফিস, আর বৌয়ের আঁচল।
বলেছে তোকে?
তোরা খুঁজবি চান্স? যাহ!
কীসের চান্স? বলতে বলতে সুলতানা ঘরে এলো।
বলে দিই? বাবর দুষ্টুমি করতে শুরু করল।
ভাল হবে না বলছি।
তবে এই যে বীরপুরুষের মত বলছিলি?
আমি ভীতু নাকি?
থাক, তুমি আর বল না। টেবিলে গ্লাশ সাজাতে সাজাতে বলল সুলতানা, জানেন ভাই সেদিন রাতে কী একটা স্বপ্ন দেখে, স্বপ্ন, তাও যদি সত্যি হতো, আমাকে ঘুম থেকে তুলেছে। তার নাকি ভয় করছে।
সেলিম বলল, আচ্ছা তুই বল, ঘুমের মধ্যে কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা সত্যি অতশত মনে থাকে?
হা হা করে হেসে উঠল বাবর।
খুব ভাল বলেছিস, কথাটা টিভি প্রোগ্রামে যুৎসই মত লাগাতে হবে।
বলেই বাবরের মনটা খারাপ হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল, একটু আগেই সে শুনে এসেছে, তার প্রোগ্রাম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এ মাসেই। সামনের মাস থেকে আর কেউ তাকে দেখবে না, পথে পথে দেখে কৌতূহলী হয়ে উঠবে না। কারো চোখ, নামটা শুদ্ধ করে বলার জন্যে নীল চিঠিতে আসবে না কোনো অনুরোধ, নতুন কোনো লতিফার সঙ্গে আর আলাপ হবে না। বাবর খুব ভাল করে জানে সিনেমা টিভি আর খেলার মাঠ এক সমান। যতক্ষণ পর্দায় আছ, যতক্ষণ গোল দিচ্ছ, ততক্ষণই লোকে মনে রাখে। তারপর কেউ ফিরেও তাকায় না। একটা হাত কেটে নিলেও এত ব্যথা হয় না। যতটা হয় পাদপ্রদীপের আলো থেকে বঞ্চিত হলে।
সেলিম কী সব পাগলের মত বলে যাচ্ছে, হাসছে, গম্ভীর হচ্ছে, প্রশ্ন করছে, সুলতানা কাটলেট এনে রেখেছে, বাবর দু একটা নিজেও কী বলেছে, কাটলেট খাচ্ছে, ঘড়িতে ঢং করে একটা আওয়াজ হলো কোথায়–কিছুই তার কানে যাচ্ছে না। অভিভূতের মত বাবর বসে একটা ছবি দেখছে–সে ছবি তার নিজের। এই তো দেখা যাচ্ছে সে প্রোগ্রাম ভিটিআর করবার দিন ভাল করে শেভ করে বিশেষ সুট পরে, গাড়িতে নয় যেন পাখা মেলে দিয়ে ডিআইটি বিল্ডিংয়ে এসে থামল। হাসি বিলিয়ে দিল একে তাকে। প্ৰযোজকের সঙ্গে কথা বলল এমন একটা গুরুত্ব নিয়ে যেন ডাঃ বার্নার্ড কারো দেহে হৃৎপিণ্ড সংযোজন করতে যাবার আগে পরামর্শ করছেন। ঐ তো সে দরোজা ঠেলে মেকআপ। রুমে ঢুকল। তার মুখে পরতের পর পরত রং লাগছে। নাকের দুপাশে ঘষে দিচ্ছে লাল। ভ্রা শুধরে দিচ্ছে পেন্সিল দিয়ে। সে বিরল হয়ে আসা চুলের গোছা টান টান করে ধরে বলছে, গোঁড়ায় একটু পেন্সিল বুলিয়ে দাও, নইলে টাক চোখে পড়ে বড্ড। তারপর যত্ন করে সময় নিয়ে সিঁথি সেরে হেয়ার স্প্রে লাগাচ্ছে সে। প্রযোজক এসে বলছে, সেট রেডি। আসুন। সে বলছে, আর এক মিনিট। বাবর সেটে ঢুকছে যেন সদ্য তৈরি নতুন রাজধানীতে প্রথম পা রাখছে কোনো তরুণ সম্রাট। কে যেন কোথায় বলছে, একটু দাঁড়ান, আলোটা দেখে নিই। ক্যামেরার পেছন থেকে কানে হেডফোন লাগানো কে এবার সাড়া দিয়ে উঠল দুহাত তুলে–স্টুডিও স্ট্যাণ্ডবাই। নিঃশ্বাস বন্ধ করে একবার টাইয়ের নট বুলিয়ে নিল বাবর। চোখ তার মনিটারের দিকে। শোনা গেল, ভিটিআর রোলিং। কয়েক সেকেণ্ড পর মনিটারে পর্দা দুধসাদা হয়ে উঠে একটি লেখা ফুটিয়ে তুলল। মারপ্যাঁচ। তারপর সেটা মিলিয়ে গেল। এবারে এলো তার নাম–পরিচালনা বাবার আলী খান। বাবর মনিটার থেকে চোখ নামিয়ে ক্যামেরার লেন্সের দিকে রাখল। ঠোঁটে সৃষ্টি করল হাসির পূর্বভাষা। তারপর, ক্যামেরার মাথায় লাল বাতিটাজ্বলে উঠতেই সে সহাস্য ঝুঁকে উচ্চারণ করল, শুভেচ্ছা নিন, বাবার আলী খান বলছি মারপ্যাঁচের আসর থেকে। বুদ্ধির মারপ্যাঁচ। দেখি আপনারা কতজন আমাকে বোকা বানাতে পেরেছেন। আমি গেলবারে মোট আটটি ধাঁধা পেশ করেছিলাম, এক-দুই-তিনচার-পাঁচ-ছয়-সাত-আটটি ধাঁধা, আপনারা উত্তর পাঠিয়েছেন, দুহাজার তিনশ সাতান্ন, তার মধ্যে সঠিক হয়েছে একুশ জনের।—
বাবর উঠে দাঁড়াল। বলল একটু বাথরুম থেকে আসি।
বসবার ঘর থেকে বেরুতে হয় পেছনের বারান্দায়, তার শেষ প্ৰান্তে একটা বাথরুম আছে।
দুটো ঘর পেরিয়ে যেতে হয়। প্রথমটা খাবার ঘর। তারপরে বাবলির। দ্রুতপায়ে বাথরুমে ঢুকে দরোজাটা বন্ধ করতে করতে তার মনে হলো বাবলিকে যেন দেখা গেছে জানালার কাছে বই নিয়ে বসে আছে। চলার তোড়ে তখন লক্ষ করেনি, থামার কথাও মনে হয়নি। কিন্তু ছবিটা চোখে লেগে গেছে। সমুখের ল্যাম্প থেকে আলোর আধখানা বৃত্ত বাবলির চিবুক স্পর্শ করেছে মাত্র। দুটো হাত বইয়ের ওপর। আলোকিত হাত দুটোকে অচেনা একটা ফুলের মত দেখাচ্ছিল। পিঠটা অন্ধকার। দূরে সবুজ চাদর পাতা বিছানা অন্তরঙ্গ করে তুলেছে জালানা দিয়ে হঠাৎ দেখা ছবিটা।
বাথরুমে এসে কিছুই করল না। বাবর অনেকক্ষণ। বাতি জ্বালিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখল। বলল তার ঠোঁট দুটিকে, তুমি আজ কাকে চুমো খেয়েছ?
আলতো করে নিজের ঠোঁট আদর করল সে। তারপর জামার কয়েকটা বোতাম খুলে দেখল, কোনো চুল পেকেছে কি-না! না, এখানে এখনো শুরু হয়নি। নিজের লোমশ বুকে হাত ঘষতে ভাল লাগল তার। কিছুক্ষণের জন্যে তাই করল সে। তারপর জামার বোতাম তাড়াতাড়ি লাগিয়ে প্যান্টের বোতাম খুলল বাবর।