আস্তে আস্তে দরোজা খুলে বেরুলো রজনী। করিডরে কেউ নেই। ইতস্তত করল একবার। চারদিক দেখল। তারপর হঠাৎ সাহস সঞ্চয় করে কুড়ি নম্বরের দরোজায় মৃদু টোকা দিল। বুকের স্পন্দনটা যেন হঠাৎ বেড়ে গেছে, তাকে আর কিছুতেই শান্ত করা যাবে না। অনেকক্ষণ পর আবার আঘাত করল দরোজায়। অস্পষ্ট উচ্চারণও করল, শুনুন। তার তখন এটুকু বোঝার মতো জ্ঞান নেই যে তার বাংলা কেউ বুঝবে না।
ভেতর থেকে এবারে বিজড়িত কণ্ঠে উত্তর এলো, কাম ইন।
লোকটার কণ্ঠ শুনে তার গা কাঁটা দিয়ে উঠল। চলে যাবার জন্যে ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠল। মুখ ফেরাবে এমন সময় দরোজা খুলে পীরজাদা বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেল। অনেকক্ষণ সাড়া না পেয়ে কে লোকটা দেখবার জন্যে বিরক্ত হয়ে উঠে এসেছিল সে। কোনো রকমে উচ্চারণ করতে পারল, আপনি!
রজনীর কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে সে আবার শুধালো, আমাকে কিছু বলবেন?
জামার বোতাম ছিল খোলা। পীরজাদা সেগুলোকে কোনো রকমে বন্দি করতে করতে পর্দা সরিয়ে ভেতরে আসবার পথ করে দিল। এবং আশেপাশে মহসিনকে না দেখে উৎকণ্ঠিত হলো। রজনীকে একবার ডাক্তার ডেকে এনে দিয়েছিল বলে লোকটা বিষ চোখে কয়েকদিন তাকে দেখেছে। এখন ঘরে আমন্ত্রণ জানানোর জন্যে হয়ত খুন করতে আসবে।
সোফার ওপরে পরিত্যক্ত পোশাক ছিল ছড়ানো। সেগুলো সলজ্জ হয়ে গুছোতে গুছোতে পীরজাদা বলল, বসুন। এ ঘরটা খুব আগোছালো। কিছু মনে করবেন না।
রজনী বসলো না। তার স্বল্প জানা উর্দু আর বইয়ের ইংরেজি মিশিয়ে কোন রকমে যা বলল তার অর্থ—- সে বসবে না, একটা কথা বলতে এসেছে।
নিশ্চয়ই সে কথা বলবে, কিন্তু বসবে না এটা কেমন কথা? অতএব বসতে হলো। কথাটা বলবার জন্যে যে শক্তির দরকার তা সেই মুহূর্তে রজনীর ছিল না বলে বসে পড়া ছাড়া পথ ছিল না তার।
আর পীরজাদা তার ভাষার অস্বাচ্ছন্দ্যে এতদূর অস্বস্তি বোধ করল যে, বাংলা না জানার জন্যে নিজেকে অপরাধী বলে মনে হলো। বলল, আপনি বলুন আমি বুঝতে পারছি।
রজনী বলল, আমি বড় বিপদে পড়েছি। আপনি ছাড়া এখানে কাউকে চিনিনে। কাল রাত থেকে ওকে দেখছি না।
কথাটা অপ্রত্যাশিত। পীরজাদা প্রথমে কিসসু বুঝতে পারল না। হা করে তাকিয়ে রইল রজনীর দিকে! তা, শ্যামল মুখের ওপর ইতস্তত দ্রুত কী যেন খুঁজে বেড়াল চোখ। বোকার মতো জিগ্যেস করল, কাকে দেখছেন না?
রজনী চকিতে একবার চোখ তুলে চোখাচুখি হতেই দৃষ্টি নামিয়ে নিল। বলল, ওকে। আপনার স্বামীকে?
রজনী মাথা নিচু করে রইল।
তখন সব কিছু স্পষ্ট হলো পীরজাদার কাছে। পায়ের আসন বদল করে বসলো সে। তখন রজনীকে সম্পূর্ণ করে দেখল। তার ভীত রক্তশূন্য মুখের পরে বেশিক্ষণ দৃষ্টি রাখতে পারল না। করতলে মাথা রেখে ভাবতে চেষ্টা করল পীরজাদা।
আবার যখন চোখ তুলল, দেখল, রজনী তার দিকে ছলোছলো চোখে তাকিয়ে আছে। সে চোখে অবোধ আকুলতা দেখে পীরজাদার বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো, বড় অক্ষম মনে হলো নিজেকে। চকিতে মনে পড়ল তার স্ত্রীর পালানো এবং বীভৎস মৃত্যুর কথা। তখন প্রবল ইচ্ছে হলো, উঠে গিয়ে সমুখে বসে থাকা ঐ ভয়ার্ত মেয়েটাকে নির্ভয় করে তোলে তার শরীর স্পর্শ করে। হয়ত সে উঠেই যেত, কিন্তু বাধা পড়ল।
মনের মধ্যে চাবুক পড়ল যেন। একী করতে যাচ্ছিল সে? রজনীর জন্যে এতদিন দূর থেকে যে দুর্বলতা গড়ে উঠেছিল, আজ তা–ই যেন আগল ভেঙ্গে ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আরেক মানুষের স্ত্রী রজনী, তার জন্যে এতটুকু মমতা করাও যে পাপ।
যেখানে তার উচিত ছিল রজনীর বিপদ দেখে সাহায্য করবার জন্যে উদ্বুদ্ধ হওয়া, সেখানে পীরজাদা স্বার্থপরের মতো নিজেরই মমতাকে প্রকাশ করবার জন্যে উদ্বেল হয়ে উঠেছে!
স্তব্ধ হয়ে ভাবলো, যদি আজ রজনী না হয়ে অন্য কোনো মেয়ে হতো তাহলে কি সে এতখানি বিচলিত বোধ করত? করত না। অন্য কোনো সময়ে হলে সে এর সিকিও অনুভব করতে। পারত না—-এইটে বুঝতে পেরে চুপ হয়ে গেল সে। তার মুখ কঠিন হলো। হৃদয়কে সে পাথর করে তুললো, যে পাথরের হৃদয় নিয়ে সে এই আড়াইটে বছর বেঁচে আছে; বলল, আমাকে মাফ করবেন, আমি কিছু করতে পারব না। আপনার বিপদের কথা শুনে আমি দুঃখিত ও মর্মাহত। আমার কিছু করবার নেই। আপনি ম্যানেজারকে খবর দিন, তিনিই ব্যবস্থা করবেন।
শুনে রজনী স্তম্ভিত হয়ে গেল। যে লোকটা তার অসুখে বিনি ডাকে এগিয়ে এসেছিল, সেই একই লোকের সমুখে সে বসে আছে বিশ্বাস হলো না। পীরজাদাকে তার মনে হয়েছিল সহানুভূতিশীল। সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি, তার বিপদের মুহূর্তে অমন রুক্ষ কথা শুনতে হবে। মানুষের ওপর রজনীর যে ভালো ধারণাগুলো ছিল তা খান খান হয়ে ভেঙ্গে গেল। পশুর মতো মনে হলো পীরজাদাকে। উঠে দাঁড়াল রজনী।
পীরজাদা বুঝতে পারল, সে অন্যায় করেছে। সে একচোখা বিচার করেছে। মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি যে কর্তব্য তা সে করতে পারল না। ক্ষমাহীন অপরাধ বোধ নিয়ে সেও উঠে দাঁড়াল এবং বিনীতকণ্ঠে বললো, আপনি হয়ত আমাকে অমানুষ ভাবছেন। আমি যে কথাগুলো বলেছি তা কোনো বিশেষ কারণে বলেছি যার সঙ্গে আপনার কোনো সম্পর্ক নেই, তাই বুঝিয়ে বলতে পারব না।
তার কণ্ঠস্বরের আন্তরিকতাটুকু রজনীকে স্পর্শ করল। তাকে আবার ভরসা করতে মনটা ইচ্ছুক হয়ে উঠল। রজনীর মন থেকে তিক্ততার খানিকটা যেন অপসারিত হয়ে গেল। বলল, আমি আর কাউকে চিনিনে বলেই আপনার কাছে এসেছিলাম।