- বইয়ের নামঃ এক মহিলার ছবি
- লেখকের নামঃ সৈয়দ শামসুল হক
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. নাসিমা ভাবলো
নাসিমা ভাবলো, এখন নাইতে পারলে অনেকটা সুস্থ অনেকটা হালকা বোধ করতে পারত সে। যখনি সে গেছে যেখানে, নাইবার সুবিধে না থাকলে টিকতে পারেনি এক মুহূর্ত। পালিয়ে এসেছে। পালিয়ে এসেছে সারাটা গায়ে অদৃশ্য কাদার, থুতুর আলপনা নিয়ে। পালানো, শুধু পালানো। এক শহর থেকে অন্য শহরে, এক মানুষ থেকে অন্য মানুষ, তৃষ্ণায়। শুধু তৃষ্ণায়।
থুতু আর থুতু। গান নেই, প্রীতি নেই। কাদা আর কাদা।
আরজু ঢাকায় থাকলে তাকে সে কপালে চুমো খেত তার এই বাসার জন্যে, যেখানে তুমি নাইতে পারো ঘণ্টার পর ঘণ্টা হাত পা প্রচুর এলিয়ে, কুয়াশা কাঁচের ভেতর দিয়ে আসা। দুধ–রোদে সারাটা শরীর ডুবিয়ে–ঠাণ্ডায়, আরো ঠাণ্ডায়।
কিন্তু ঘণ্টা দুয়েকও হয়নি সে দিনের দ্বিতীয় অবগাহন সেরে ফিরেছে। তাছাড়া সময়টাও শীতের মাঝামাঝি। তাই তৃতীয়বার তাকে এই লোভনীয় শীতলতা টানলেও নাসিমা দ্বিধা করলো। তবু নাসিমা আবার নাইতে গেল। ফিরল যখন, তখন টেবিল ঘড়িতে পাঁচটা বেজে গেছে।
নতুন করে আবার প্রসাধন করতে বসলো সে।
আরজুর রুচি আছে, আছে রুচি মেটানের জন্যে উদার স্বামী। ইউনিভার্সিটির ক্লাশ পড়ানো ছাড়াও যার আরেকটা কাজ আরজুকে ভালোবাসা।
আচমকা গলায় হাত থেকে পাউডারের তুলিটা কেঁপে গেল।
মতির মা দরোজার কাছে উঁকি দিয়ে বলছে, চা দেব?
প্রশ্নটা আবার করে মতির মা। কোরে, মিষ্টি মিষ্টি হাসে। এ হাসিr অর্থ প্রথম দিনেই জানা হয়ে গেছে নাসিমার। বলতে চায় কৌতুকে—-আবার নেয়েছ তুমি?
নাসিমা আখতার, ডুব দাও আরো অতলে।
আজ আটদিন হলো ঢাকায় আরজুদের এখানে সে উঠে এসেছে। আর সে পৌঁছুবার ঠিক পরদিনই কক্সবাজার চলে গেছে আরজু, তার স্বামী আর বাচ্চা মেয়েটা। নাসিমা এসেছিল হঠাৎ কোনো খবর না দিয়ে, তাই আরজুদের বেরুনোর তারিখ বদলানো সম্ভব হয়নি। আরজু বলেছিল, তুই থাক, আমরা দিন দশেকের বেশি থাকব না। তারপর গল্প করা যাবে, কী বলিস? তুইতো আমাদের এমন ভুলে গেছিস যে তিন বছরে একটা খবরও নিসনি। না, না, তুই যেতে পারবিনে। ঢাকায় এসেছিস, আমার এখানেই থাকবি। আগে জানলে আমরা না হয় দুদিন পরেই যেতাম। উনি সব টিকিট-ফিকিট কিনে ফেলেছেন। একলা থাকতে পারবি না?
আরজুও জানে, নাসিমাকে প্রশ্নটা করা শুধু কিছু একটা বলার জন্যেই। একাকীত্ব যার জন্ম-সহোদর এ প্রশ্ন তার কাছে অর্থহীন। তবু সে বলেছে, পারব। কেন পারব না?
বরং এতে খুশিই হয়েছিল নাসিমা। এই ভালো হলো! সারাটা বাড়িতে একটা সাজানো সংসারে সে একা থাকবে—-হোক মাত্র কয়েকদিনের জন্য—-এই ভালো হলো, এই মুক্তিই সে তার ঈশ্বরের কাছে চেয়েছিল আজ– করাচি থেকে তার প্লেন যখন লাফিয়ে উঠেছিল আকাশে, সেই তখন থেকে। সমস্ত বাড়িঘর পৃথিবী আর ঘাস পায়ের তলায় বিলীন হয়ে যেতে যেতে তাকে যেন পাঠিয়ে দিচ্ছিল এমনি একটা পরিবেশে, যেখানে কেউ তাকে জানবে না, যেখানে যারা চেনা তারাও যাবে চলে, যেখানে তাকে একটা একটা করে সমস্ত কিছু ক্লান্ত দুচোখ দিয়ে আবিষ্কার করে নিতে হবে।
নাসিমা তখন চোখ ভরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আরজুর সারাটা সংসার দেখার প্রেরণা অনুভব করেছিল। যে দ্রুত আকাশযান তাকে নিয়ে এসেছে এই দীর্ঘপথ ঠিক তারই মত অনায়াস একটা ধাতবগতি সঞ্চারিত হলো তার অনুভূতিতে সে অনুভূতি চলেছে দ্রুত কিন্তু তার প্রেক্ষিত অপসারিত হচ্ছে মেঘমন্থর রীতিতে। ডুব দাও অতলে, আরো অতলে।
.
এরোপ্লেন আকাশপথে তার দিশারী নীলরেখায় পড়বার সঙ্গে সঙ্গে সিটবেল্টা খুলে ফেলল নাসিমা আখতার। অদ্ভুত একটা শিরশির সুরভি জড়ানো ঠাণ্ডা হাওয়া সারাটা প্লেনের গহ্বর আচ্ছন্ন করে আছে। আর একটানা একটা ধ্বনি, নাসিমার হৃদস্পন্দনের মত ধুকধুক, নিয়মিত, দায়িত্বশীল।
নাসিমার পাশের সিটে বসেছে বছর এগারোর একটা ছেলে। মাথায় বাদামি রঙ চুলের দুষ্টুমি ছেলেটার রক্ত উজ্জ্বল সারাটা মুখের সঙ্গে প্রীতিময় হয়ে আছে। তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে, চোখ ফিরিয়ে নেয়া যায় না। এয়ারপোর্টে ছেলেটাকে তুলে দিতে এসেছিল বোধ হয় কোন নিকট আত্মীয়। অনর্গল কথা বলছিল ছেলেটা তার সঙ্গে। সেই তখনই নাসিমার চোখে পড়েছিল। এখন বসেছে ঠিক তার পাশে। আত্মীয়টি তাকে টফি কিনে দিচ্ছিল আর মাথায় আঙ্গুল দিয়ে ব্রাশ করছিল তার। নসিমা একটা মোচড় অনুভব করছিল তার বুকের ভেতর। ছেলেটার দ্রুত দুহাতে ছিঁড়ে ফেলা টফির সিলোফেনের মত তার হৃদয়ের পর্দাগুলো যেন কোথাও একটা অদৃশ্য হাতে ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছিল।
প্লেনে ওঠবার যখন সময় হলো তখন, না তখন নয় তার কিছু আগেই, ছেলেটা কেমন নিভে গেল। আত্মীয়টি আধে: উবু হয়ে তার কানের কাছে মুখ রেখে বলল, ডোন্ট ক্রাই বব, ইউ আর গোয়িং টু ইওর ড্যাড—- উওর নিউ মম–ইওর ফাদারস বিগ ব্রাদারস গার্ল—-দে আর ওয়েটিং ফর ইউ। ডোন্ট ক্রাই, ডোন্ট ক্রাই।
ছেলেটার চোখে আঙটির পাথরের মত অশ্রু টলটল করছে।
নাউ বি এ ব্রেভ বয়। সে গুডবাই। নাউ–ডোন্ট লুক ব্যাক–গো অন।
ভিড়ের ভেতরে ডুবে যেতে যেতে নাসিমাব মনে হলো, ছেলেটা কি পেছনে তাকিয়েছিল? কিন্তু ফিরে সে দেখল না। ডোন্ট লুক ব্যাক। নাসিমা প্লেনের গহ্বরে চলে যেতে যেতে একবারও তাকায়নি পেছনে। আমরা কেউ কখনো তাকাই না অতীতের অন্ধকারের দিকে। কিন্তু অতীত তার দুই গভীর চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে আমাদের চলমান মিছিলের দিকে। বিন্দু বিন্দু ঘাম নাসিমার কপালে একসার ফৌজের মত স্থির হয়ে থাকে। প্লেন তখন টেক অফ করছে। সারা শরীরে হঠাৎ একটা শূন্যতা ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে নাসিমা মুহূর্তের জন্য নিজেকে যেন ফিরে পেল। মনে হলো, এমন একটা শূন্যতার বিনিময়ে সে আজ তার সমস্ত দুয়ার খুলে দিতে পারে। এই অতল শূন্যতা দিয়ে বাহিত হয়ে যাওয়া অনেক ভালো, মাটিতে দাঁড়িয়ে তৃষ্ণার তীরে রক্তাক্ত হওয়ার বদলে।