কিন্তু কথাটা বলতে সাহস হয় না। মহসিন যে অমিত আশা নিয়ে এসেছিল তা নিভে গেছে। না বললেও রজনী এটা এখন স্পষ্ট করে জানে। মহসিন বুঝেছে, তার স্বল্পবিদ্যে এবং শূন্যের মূলধন দিয়ে এমন বড় কিছু করা যাবে না যাতে রজনী ও তার কল্পনার সংসার বাস্তব হয়ে উঠবে। অথচ ফেরবার পথ নেই। একেকদিন কাজ খোজার অছিলায় সারাটা দিন সে কাটায় ক্লিফটনে।
সমুদ্রের গর্জন তবু চিন্তাকে অবশ করে রাখতে পারে খানিকটা। চোখের সমুখে পৃথিবীর একদল হাস্যমুখরিত মানুষ, মেলা, নাগরদোলা দেখে দুর্বহ সময়কে সহনীয় করে তোলা যায়। একেক দিন মহসিনের মনে প্রশ্ন উঁকি দেয় কেন সে রজনীকে নিয়ে এসেছিল? রজনীর ওপর তার ভীষণ রাগ হয়। মেয়েটা কেন আসতে রাজি হলো তার সঙ্গে?
৩. হোটেল কোলামবাস
হোটেল কোলামবাসে এসে গাড়ি থামলো পীরজাদার। রাত তখন সাড়ে তিনটে। দূর থেকে সমুদ্রের ক্ষুব্ধ গর্জন ভেসে আসছে। একবার ভাবলো, ক্লিফটন থেকে বেড়িয়ে আসে। অমন কত রাতে একা একা সে হেঁটেছে ক্লিফটনের বালুবেলায়, কী গাড়িতে চুপ করে বসে থেকে সমুদ্রকে শুনেছে।
আজ একটু বেশি পান করে ফেলেছে পীরজাদা। কেমন যেন ঘুম জড়িয়ে আসছে। থাক ক্লিফটন।
পোর্টার বসে বসে ঝিমুচ্ছিল। সালাম করে উঠে দাঁড়াল তাকে তেতলা অবধি পৌঁছে দেয়ার জন্য। পীরজাদা হাতের ইশারায় তাকে নিরস্ত করে একাকী সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। নিঃসঙ্গতা কাটাবার জন্যে কিছু একটা আবৃত্তি করতে ইচ্ছে করল তার। কিন্তু কিছুই মনে পড়ল না। কেবল কতগুলো অসম্বদ্ধ অর্থহীন শব্দ গড়িয়ে পড়ল মুখ থেকে।
রজনীর কামরার সমুখে এসে থমকে দাঁড়াল পীরজাদা। এতরাতেও ঘরে আলো জ্বলছে। স্কাইলাটের কাঁচের ভেতর দিয়ে চৌকো সোনার পাতের মতো আলো পড়ে আছে তার পায়ের কাছে। ভেতরে কোনো শব্দ নেই, সাড়া নেই। পীরজাদা সোনার পাতের মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালো। এত রাতে তো কোনদিন ওদের ঘরে আলো জ্বলে না।
মাথার মধ্যে অত্যধিক সুরা ছিল বলেই বোধ হয় সে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। একটা যুগও চলে যেতে পারতো। হঠাৎ ঘরের মধ্যে মৃদু পায়ের শব্দে কান খাড়া করে তাকাল। ঘরের মধ্যে বাতি নিবলো। পীরজাদা তখন চলে যাবার উদ্যোগ করবে, এমন সময় দপ্ করে আবার সেই সোনার পাত এসে তার পায়ের ওপর পড়লো। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল সে। বাতি আর নিবলো না।
এসে নিজের ঘরে সটান শুয়ে পড়ল বিছানায়। সঙ্গে সঙ্গে বিছানাটা দুলে উঠলো কেয়ামারির সাম্পানের মতো। আলো, চেয়ার, টেবিল, পর্দা, জাগ, সমস্ত কিছু নিয়ে এক প্রচণ্ড টানে সাঁতারুর মতো সোজা তলিয়ে গেল সে ঘুমের ভেতর।
রজনী ভেবেছিল অন্ধকারে শুয়ে থাকতে পারবে। বুকের মধ্যে তো ঢিপঢিপ করছিল। বাতি নেভানোর সঙ্গে সঙ্গে মনে হলো হৃদয়টা এখুনি ছিঁড়ে যাবে ভয়ে। তক্ষুণি আবার বাতি জ্বালিয়ে ঘরের মধ্যখানে সে দাঁড়িয়ে রইলো। সর্ব অঙ্গ তার থরথর করে কাঁপছে। আরো শঙ্কা হলো যখন বাইরে শুনল পায়ের শব্দ। কে যেন দাঁড়াল, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল। একবার মনে হয়েছিল, দরোজা খুলে দেখে। কিন্তু সাহস হয়নি। পরে সে শুনল, পায়ের আওয়াজটা একেবারে শেষ মাথায় গিয়ে থামল, তারপর দরোজা খোলার শব্দ। তখন বুঝলো পীরজাদা ফিরেছে।
সব রাত পোহায়। দুঃখের রাতও শেষ হয়। সূর্য ওঠে। সারাটা রাত জেগে বসেছিল রজনী। রাতের বেলায় তবু সব কেমন যেন দুঃস্বপ্ন বলে মনে হচ্ছিল। দিনের আলোয় তা নিষ্ঠুর সত্য হয়ে ফুটে উঠল।
রাতে শুয়ে ছিল দুজনে। মাঝরাতে পাশে হাত পড়তেই রজনী চমকে উঠেছে। মহসিন নেই। প্রথমে মনে করেছিল বাথরুমে গেছে। কিন্তু পনেরো বিশ মিনিট কেটেছে, সাড়া নেই। তখন সে উঠে বসেছে। নাম ধরে ডেকেছে। সাড়া আসেনি। বাতি জ্বালিয়ে দরোজা খুলে দেখে শাওয়ার থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ছে নিত্যকার মতো সে নেই। সারাটা ঘর। শূন্য। তখন ভীষণ ভয় করলো রজনীর। চোখের সামনে সব দেখেও কিছুই যেন সে দেখতে পারছে না। তার মাথায় কিসসু ঢুকছে না। মহসিন তাকে ফেলে পালিয়ে গেছে, এ সত্যটা কিছুতেই সে যেন বুঝতে পারছিল না। কেবল কী রকম একটা অতল ভয় করছিল। আর কিছু না।
বেয়ারা এসে সকালের চা দিয়ে গেল। চা স্পর্শ করলো না। কিছুক্ষণ পর ব্রেকফাস্ট আনলো, যেমন রোজ আনে, দুজনের জন্যে। দুজনের ব্রেকফাস্টের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলো সে। সব কিছু দুজনের। কিন্তু একজন নেই। মায়ার মতো একবার আশা হলো হয়ত ফিরে আসবে মহসিন। কিন্তু দুপুর হয়ে গেল, সে এলো না।
অবাক হলো বেয়ারা। জিগ্যেস করল, মেমসাব কা তবিয়ৎ কেয়া ঠিক নেহি?
বুড়ো পাঠানের কণ্ঠে এমন একটা মমতা ছিল, রজনীর মনে হলো এখুনি তার চোখে পানি এসে পড়বে। তাড়াতাড়ি সে কোন রকমে মাথা নেড়ে একটা হা–না গোছের জবাব দিল। বেয়ারা জিগ্যেস করল, সাহেব কি ভোরে ভোরেই কাজে বেরিয়ে গেলেন? তারও জবাব সে দিল না। বরং একটা কথা জিগ্যেস করার ফলে সে যে পরিত্যক্ত এইটে প্রকট হয়ে উঠলো তার মনের মধ্যে। বুড়ো পাঠান কী বুঝলো কে জানে, ট্রে উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল। জাগে ভরে দিয়ে গেল নতুন পানি।
সে যাবার পর টসটস করে দুফোঁটা উষ্ণ অশ্রু গড়িয়ে পড়ল রজনীর গালে। তা মুছে ফেলার। কথা মনে হলো না। ফোঁটা হলো প্রস্রবণ। অনেকক্ষণ নিঃশব্দে বসে বসে কাদলো রজনী। উঠে দাঁড়াতেই জানালা দিয়ে দূরে শহর চোখে পড়ল তার। রুক্ষ ধূসর মাটিতে ছোট বড় দালান, একটা দুটো গাছ, গাড়ি চলছে, কয়েকটা ছেলেমেয়ে স্মার্ট পোশাক পরে রোদের। মধ্যে কুটিপাটি হাসতে হাসতে রাস্তা পার হচ্ছে। এ সবের যেন কোন মানে বোঝা যাচ্ছে না। এ যেন আরেকটা পৃথিবীতে ঘটছে, আর সে, রজনী, তার কোনো শক্তি নেই সেখানে যেতে পারে।