পীরজাদা খানিকক্ষণ ছটফট করলো বসে থেকে। মনে হলো জ্বরটা তারই হয়েছে। নিচে নেবে এসে গাড়ি করে তার বন্ধু ডাক্তারটিকে ডেকে নিয়ে এলো দশ মিনিটের মধ্যে। সেই বিষ মেশানো হুইস্কির আড়াই বছর পরে আজ প্রথম বন্ধুটির বাড়িতে তার পদার্পণ। তাই সে তক্ষুণি এলো এবং রোগিনীকে দেখে অবাক হলো। তার কী ধারণা হলো কে জানে, ডাক্তার মানুষ অসুস্থ মানুষের সমুখে ব্যক্তিগত কিছু জিগ্যেস করল না। ওষুধ দিয়ে চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল, পীরজাদা আমার সঙ্গে একবার টেলিফোনে কথা বোলো।
তখন তার কথা শুনে যে কেউ বুঝতে পারত এ মেয়েটার সঙ্গে পীরজাদার কী সম্পর্ক সেইটে জানবার জন্যে তার কৌতূহল ফেটে পড়ছে। কিন্তু তখন পীরজাদার মাথার মধ্যে রজনীর ব্যথাক্লিষ্ট মুখ; ভাববার মতো মনের অবস্থা তার নেই।
ডাক্তার চলে যাবার পর রজনীর পায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল পীরজাদা। তখন মেয়েটা একটা কথাই উচ্চারণ করেছিল, শুকরিয়া। সেই একটি মাত্র শব্দ যেন সহস্রের অভিধা নিয়ে বাজলো পীরজাদার হৃদয়ে। সে আর কিছু নয়, উদ্বেলিত হৃদয়কে শান্ত করে, কোন রকমে বলে গেল, আমি কুড়ি নম্বরে থাকি। বাইরে বেয়ারাকে বলে গেলাম থাকতে। দরকার পড়লে ডাকবেন।
মনের মধ্যে একটা দুরন্ত আশা ছিল, রজনী তাকে যেতে দেবে না। কিন্তু রজনী কিছুই বলল না। পীরজাদা তার ঘরে ফিরে এসে জেগে রইলো উল্কণ্ঠা বুকে নিয়ে।
না, সে রাতে আর পীরজাদার ডাক আসেনি। মহসিন ফিরে এসেছে, তার কণ্ঠস্বরও শুনেছে। মহসিন ওষুধ নিয়ে এসে দেখে, রজনীর চিকিৎসা আগেই হয়ে গেছে। উদ্যোক্তার পরিচয় বেয়ারার কাছ থেকে পেয়ে খুশিও হতে পারল না, অনধিকার চর্চা বলে ক্রুদ্ধও হতে পারল না। লোকটা যা করেছে তা মানবিক। মানবিকতার এমন এক প্রচণ্ড শক্তি আছে, যে, মালিন্যকে তার সামনে মাথা নত করে থাকতে হয়।
মহসিন যে ব্যাপারটা ভাল চোখে দেখেনি, এটা বোঝা গিয়েছিল তারপরে বহুবার পীরজাদা মুখোমুখি পড়েও একটা কথা না বলা বা ধন্যবাদ না দেয়াতে। এটা লক্ষ্য করে পীরজাদা মরমে মুষড়ে রইলো, যেন একটা বিরাট অপরাধ করে ফেলেছে সে। কদিন চোরের মতো পালিয়ে সে ঘর থেকে বেরুতো, ঘরে ফিরত, পাছে সামনে পড়ে যায় মহসিনের বা রজনীর। আর রজনীর উচ্চারিত একটি মাত্র শব্দ শুকরিয়া—-রজনী তার সীমিত উর্দুজ্ঞানে ঐ একটি মাত্র কথাই বলতে পেরেছিল—-সেটা পীরজাদার কানে অমৃতের মতো লেগে রইলো।
তারপর থেকে এমন হলো, হোটেলে ফিরলেই বুকের মধ্যে সে রজনীর অস্তিত্ব টের পেত। এই নতুন অনুভূতিটা বেশ কিছু দিন উপভোগ করলো পীরজাদা। এই সারাক্ষণ মনের মধ্যে কান পেতে থাকা, দূরে বাড়িগুলোর বিন্দু বিন্দু আলোর মধ্যে রজনীর মুখের আভাস সৃষ্টি, হঠাৎ চোখে পড়া রজনীর একটা শাড়ির রং—- সমস্ত কিছু মিলিয়ে এক মন্ত্রের নিগড়ে যেন বাঁধা পড়ে গেছে সে।
দিন দশেক পরে একদিন বিকেলে রজনী আর মহসিনকে বেরুতে দেখা গেল। পীরজাদা এর আগে কখনো দুজনকে এক সঙ্গে দেখেনি। রজনী পরেছে একটা ছাই রং শাড়ি—-যেন তার গায়ের রং ভোরের আলো লেগে ফিকে হয়েছে। কবরী রচনা করে তাতে দিয়েছে মোতিয়ার বেড়। চলনে ফুটে উঠেছে আন্দোলিত কুসুমের ছন্দ। মুগ্ধ হলো পীরজাদা এবং অনুতপ্ত হলো।
অনুতাপ কারণ, এই প্রথম তার মনে পড়ল রজনী বিবাহিতা। এ সত্যটা জেনেও তার মন এতদিন চাতুরি করে ভুলে বসে ছিল। ধিক্কারে ভরে উঠলো সমস্ত মন। চোখ ফিরিয়ে সে ঘরে ঢুকলো। এ সম্পর্কে আর দশটা মানুষের চেয়ে পীরজাদার ভয়টা ছিল সবচে বেশি। তার নিজের স্ত্রী অন্য এক পুরুষের প্রেমে পড়ে একদিন তাকে হত্যা করতে চেয়েছিল বিষ খাইয়ে। ছি ছি করতে লাগল তার আত্মা। চেয়ারে কাঠ হয়ে বসে থাকবার, নিজেকে সংযত করবার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগল, এ তার কী হলো? জীবনের জন্যে, বেঁচে থাকার জন্যে, আবার সে দিশা খুঁজে আবারো কি ডেকে আনবে আরেক মৃত্যু?
পীরজাদা ছটফট করছে। ভাগ্যের পরিহাস, যে কারণে ছটফট সেটা অমূলক। কিন্তু সে কথা সে জানবে কি? এ কথা রজনী ছাড়া আর কেউ জানে না যে, মহসিনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়নি? বিয়ের জন্যে ঘর ছেড়েছিল। হোটেলের ভাড়া করা ঘরে প্রথম রাতেই রজনীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও বাসর হয়ে গেছে। মন তো দিয়েছিল, মনের আঁধারটিকেও সমর্পণ করতে হয়েছিল মহসিনের উত্তুঙ্গ ইচ্ছার মুখে। কিন্তু বিয়ে হয়নি।
মহসিন বোঝাতে চেষ্টা করত, দ্যাখো, এটা নতুন জায়গা। কিছু জানিনে শুনিনে, কোথায় কাকে গিয়ে বলবো বিয়ে পড়িয়ে দাও। বিয়ে তো আমাদের হয়েই গেছে। হয়নি? বিয়ের চেয়েও এখন যেটা বড়, আমার একটা কাজ দরকার, আমাদের একটা বাসা দরকার—-কই সে কথা তো তুমি আমাকে কিছু বলো না।
শুনে রজনী মরমে মরে যেত। তাইতো, আগে একটা কাজ দরকার। ভয়ে বুক শুকিয়ে যেত, কাজ না পেলে খাবে কী? কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তখন আর কিছু দিশেবিশে না পেয়ে মহসিনের বুকের মধ্যে নিজেকে রেখে সহানুভূতি আর সাহস ঢেলে দেয়ার ভীরু চেষ্টা করত সে।
এই করে চলছিল। কিন্তু রজনী বাংলার মেয়ে। নিয়মাচারের জন্যে তারা আজো জীবন দিতে জানে। মহসিন যেখানে দিনের পর দিন ভগ্নহৃদয়ে ফিরে আসছে কাজের কোন হদিশ না পেয়ে, সেখানে রজনীর তো উচিত ছিল তাকে সাহসে বলীয়ান করে তোলা, তার ইচ্ছার। সমুখে বিনীতা হওয়া। কিন্তু ঘটনো উলটো। যত দিন যাচ্ছে রজনীর প্রেমের গোলাপে কাটার। সংখ্যা বাড়ছে সমপরিমাণে। এই সত্যটা তাকে দগ্ধে মারছে যে, সে তার বিবাহিতা স্ত্রী নয়। সে অনাচার করছে। তার প্রেম বড় নয় তার ক্ষুধা বড় নয়, তার আশ্রয় বড় নয়—-তার সব প্রয়োজনের বড় যে প্রয়োজন সেটা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়ছে।