এলফিনস্টোন স্ট্রীটে দোকানগুলোর শো প্যানেলে এখনো তীব্র আলো জ্বলছে। মূর্তিগুলোর গায়ে পরানো বডিস, শার্ট, টাউজার। কোনটা বন্ধ, কোনটার শুধু উর্ধ্বাঙ্গ। খোলা স্যুটের কাপড় হঠাৎ স্তব্ধ ঝর্ণার মতো ঝুলছে। অতিকায় সিগারেটের টিন থেকে উঁকি দিয়ে আছে জাদুকরের লাঠির মতো সিগারেট। আকাশে নিয়ন বাতির দীপ্তিতে লেখা বিজ্ঞাপন জ্বলছে, নিবছে, জ্বলছে। একটা বিজ্ঞাপনের চারদিকে সহস্র বিন্দুতে খণ্ড খণ্ড লাল বর্ডার নর্তকীর মতো লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরছে। বিরাম নেই সে চলার।
পীরজাদা একটা সিগারেট ধরালো। সারা রাতে খাদ্যবস্তু কিছু পেটে পড়েনি এক প্লেট চীনাবাদাম ছাড়া। এখন কিছু খেতে পেলে ভালো হতো। ভাবলো, গাড়িটা ঘুরিয়ে যাবে কোনো হোটেলে। হয়ত এখনো কোথাও ফ্লোর শো হচ্ছে, রান্নাঘরে কিছু থাকতে পারে।
রেক্স সিনেমা পেরিয়ে ফোয়ারার কাছে আসতেই আকাশের দিকে চোখ পড়ল পীরজাদার। সে আকাশে তারার চন্দন ফোঁটা। তৎক্ষণাৎ তার চোখের সমুখে ভেসে উঠলো কল্পনার সেই নিকষ কালো মহিলার মুখ। সে যেন চোখের ইশাবায় ডাকছে। পীরজাদা আর কোন দিকে তাকাল না, ফিরল না, সোজা তার গাড়ি ছুটল হোটেল কোলামবাসের দিকে।
মাসখানেক হলো একটা নতুন জিনিস লক্ষ্য করছে পীরজাদা। আকাশের সেই কাল্পনিক মুখেব কথা মনে পড়তেই আচমকা আরেক জনের কথা মনে পড়ে যায় তার। সে ব্যক্তিটি তার দুকামরা পরের অধিবাসিনী রজনী। রজনীকে প্রথম যেদিন দেখেছিল, সময়টা সন্ধ্যে, চমকে উঠেছিল পীরজাদা। বুকের মধ্যে মোচড় অনুভব করেছিল যেন জন্মজন্মান্তরের ব্যথা। মন হয়েছিল, রজনীর কালো মুখের লাবণ্য দেখবার জন্যেই এতকাল ধরে সে বেঁচে আছে।
পীরজাদা অবাক হয়ে দেখত রজনীকে। ভীরু, নম্র, সচকিতা, তাড়া খাওয়া হরিণীর মতো মেয়ে। বোধহয় অস্পষ্ট করে একটা সাদৃশ্য এবং সান্ত্বনা খুঁজে পেত প্রথম পর্যায়ে তার স্ত্রীর গ্রামীণতার সঙ্গে।
হয়ত সকালে এসে বারান্দায় দাঁড়িয়েছে রজনী, পদশব্দে চোখ ফিরিয়ে পীরজাদা তাকিয়ে থাকত। তার চোখে কী থাকত কে জানে, রজনীর লজ্জা করত। ঘরে চলে যেত সে তাড়াতাড়ি। বুকের মধ্যে দুপদুপ করত।
তার পালানোটা চোখে পড়েছিল পীরজাদার। তারপর থেকে রজনীর মুখোমুখি পড়ে গেলে পীরজাদাই সরে যেত।
আর রজনীর সঙ্গে যে লোকটা এসেছে, মহসিন, পীরজাদা তাকে হোটেল থেকে রোজ ভোরে বেরুতে দেখত। ওর খুব ইচ্ছে করত দুজনের সঙ্গে কথা বলে, কিন্তু নিজের দুর্ভাগ্যের সঙ্গে ও এতখানি পরিচিত যে ভয় হতো তাতে করে সবটাই হারিয়ে যাবে। এই যে রজনীকে দেখে তার মনের মধ্যে কেমন একটা উপশম হচ্ছে, শান্তি হচ্ছে, সেটা আর থাকবে না। হয়ত রজনীরা চলে যাবে। আর কোনদিন খুঁজে পাওয়া যাবে না এ শহরে।
মেয়েটাকে বোঝা যেতো না। কী যেন ভাবে ও। সারাক্ষণ ভাবে। সারাদিন ওর মনটা কোথায় যেন পড়ে থাকে। পীরজাদা খুব অবাক হতো মানুষের এত তন্ময় হয়ে থাকার ক্ষমতা দেখে।
আর একটা জিনিস বুঝতে পারত না সে। তা হচ্ছে ওরা হোটেলে আছে কেন? দেখে ওদের আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে যে ধারণা হয় তাতে কোন তৃতীয় শ্রেণীর হোটেলে থাকারই কথা। এখানকার এত খরচ তারা জোগাচ্ছে কি ভাবে? কিন্তু এ ভাবনা তার ভেবে কি লাভ? সে মাথা ব্যথা হোটেল ম্যানেজার ইব্রাহিম বালোচের।
কেবল একদিন কথা হয়েছিল রজনীর সঙ্গে। সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল করাচিতে যা সচরাচর হয় না। বারান্দায় এসে পড়ছিল বৃষ্টির ছাঁট। ভিজিয়ে দিচ্ছিল। রজনীর হয়ত মনে পড়েছিল, বাংলায় তার বাসার মধ্যে এমন সব দিনে ছাদের পরে অবাধ স্বাধীনতার কথা। সে বৃষ্টিতে খুব করে ভিজল। মহসিন নিত্যকার মতো বেরিয়েছে কাজের সন্ধানে। ফিরে এসে দেখে রজনীর গায়ে তাপ, জ্বর এসেছে।
রজনী তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, আমি মরে যাবো। আমাকে বাড়িতে নিয়ে চলো। বিব্রত হলো মহসিন। বাড়ির উল্লেখ মনের মধ্যে খচ করে বিধলো। বলল, তুমি একটু শুয়ে থাকো, আমি ডাক্তার নিয়ে আসছি।
অতরাতে মহসিন বেরুলো ডাক্তারের খোঁজে। করাচির কিসসু জানে না চেনে না, ম্যানেজার একটা ঠিকানা দিয়ে দিল, সেইটে নিয়ে সে ছুটলো। এ দিকে ঘরে কাত্রাচ্ছে রজনী। ভুল বকছে। বলছে, আমাকে বাড়ি নিয়ে যাও, আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাও।
কামরায় ফিরছিল পীরজাদা। ঘরের মধ্যে থেকে মেয়েটার কাতরোক্তি শুনে থমকে দাঁড়াল। ব্যাপারটা অনুমান করতে চেষ্টা করল। কিছু বোঝা গেল না। মহনি ঘরে আছে কিনা তাও বুঝতে পারল না। পোর্টারকে ডেকে বলল সংবাদ দিতে। সে এসে জানাল, রজনী একা। জ্বর এসেছে।
ঘরে যাওয়া হলো না পীরজাদার। রজনীর ঘরে ঢুকতে ইচ্ছে করছিল, তাও দ্বিধায় মরে গেল। ওদের কামরার সমুখে সে দাঁড়িয়ে রইলো চুপ করে। রজনীর যন্ত্রণা বুঝি আবার বাড়লো। বার থেকে মনে হলো একটা কাটা কবুতর দাপাচ্ছে।
পীরজাদা ভেতরে এসে বলল, পানি দেব?
রজনী তাকে দেখল বড় বড় চোখ মেলে। এক মুহূর্তে শান্ত হয়ে গেল সে। কী বলল বোঝ গেল না। পীরজাদা তার পাশে চেয়ার টেনে নিয়ে বসলো। জিগ্যেস করল, জ্বরটা কখন? আপনার স্বামী কোথায়? চোখ দিয়ে একটা ইশারা করল রজনী যার কোন মানে হয় না। পীরজাদা যদি মনের ভাষা শুনতে পেত, তাহলে শুনতে পেত, মেয়েটা বলছে আমার স্বামী কে? যে বিয়ের জন্যে ঘর পালানো, সে বিয়ে তো আমার আজও হয়নি।