এ ড্রিংক সে নিজে বানাতো, চিরকাল এটা ছিল উপভোগের আরেকটি অংগ। একদিন ঘরে ফিরে দেখল তার স্ত্রী বানাচ্ছে। দেখে অবাক হলো, খুশিও হলো। পাঁচদিন কথা না বলার সেই সময়টার স্মৃতি তখনো তাজা। তাই স্ত্রীর এই ব্যবহারে পীরজাদা অভূতপূর্ব এক অন্তরঙ্গতার স্বাদ পেল। এবং এটা যখন তার স্ত্রীর একটা নিয়মিত কাজ হয়ে দাঁড়াল তখন তার হৃদয় থেকে সমস্ত মালিন্য সন্দেহ মুছে গিয়ে বইলো অনুরাগের নির্মল ঝর্ণা। সুখ বলতে পীরজাদার চোখের সমুখে তখন ভেসে উঠতো তার স্ত্রীর ছবি, যে হাসছে, যে এগিয়ে দিচ্ছে তাকে সারাদিনের ক্লান্তির পর বিকেলের পানীয়।
কিন্তু সুখের কপাল নিয়ে পীরজাদা পৃথিবীতে জন্মায়নি। জন্ম মুহূর্তে মা–র মৃত্যু থেকে তার শুরু। এমন কিছু লোক আছে যারা নিজের দুর্ভাগ্য নিজে বানায়, তাদের বানাতে হয়, স্বেচ্ছায় নয়, অনিচ্ছায়। পীরজাদা সেই দলের মানুষ।
সেদিন বিকেলে এসে স্ত্রীর হাত থেকে পানীয় নিয়ে চুমুক দিতেই মুখটা বিস্বাদ হয়ে গেল তার। স্ত্রী হেসে জিগ্যেস করল, কী হয়েছে? খাও।
পীরজাদা অপ্রস্তুত হয়ে আরেক চুমুক পান করে টাই খুলল। খুলতে খুলতে ভাবল, আজ কি এমন কিছু ঘটেছিল যার জন্যে তার মেজাজ খারাপ হয়ে আছে, ফলে বিস্বাদ লাগছে এই পানীয়? না, তেমন কিছু তো হয়নি। বরং আজ একটা ভালো দিন বলা যেতে পারে। কাজে ছিল স্বাচ্ছন্দ্য, মনোযোগ; বাইরে বাতাস ছিল সুন্দর, পথে ছিল না তিলমাত্র ভিড়। তবে? পীরজাদা আবার গ্লাসটা হাতে নিল। এক চুমুকে বাকিটুকু নিঃশেষ করবার জন্যে হাঁ করল সে। ঠিক সেই মুহূর্তে দেখতে পেল স্ত্রীর ঠোঁট কাঁপছে। চোখ এক পলকের জন্য বিস্ফারিত হল; আতঙ্কে বরফ হয়ে গেল মেয়েটা হাত থেকে গ্লাস নামালো পীরজাদা—-হয়ত চোখের ভুল, হয়ত গ্লাসের মধ্য দিয়ে দেখেছে বলে অমন মনে হয়েছে। ভালো করে দেখবার জন্যে হাত থেকে গ্লাস নামালো পীরজাদা।
সঙ্গে সঙ্গে আরেক বিস্ময়। তার স্ত্রী প্রায় দৌড়ে, অস্পষ্ট একটা কাতরোক্তি করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সম্পূর্ণ ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটল যে হাতের গ্লাস হাতে রইল পীরজাদার যেন চলমান ছবি স্থির হয়ে গেছে।
পাশের ঘরে এসে দেখে স্ত্রী বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছে। সমস্ত মুখ তার শাদা হয়ে গেছে, দরদর করে ঘাম পড়ছে। পীরজাদা তাকে বুকের মধ্যে নেবার চেষ্টা করল। সে এলো না। জিগ্যেস করল, কী হয়েছে? উত্তর পাওয়া গেল না। পীরজাদার মনে হলো। হঠাৎ তার বড় মাথা ধরল। সে আবার জিগ্যেস করল, কী হয়েছে? এবারে তার কণ্ঠস্বরে ছিল কিছুটা উত্তাপ। সচকিত হয়ে স্ত্রী তখন তাকে একবার দেখল। বলল, ও গ্লাস তুমি ফেলে দাও। খেও না।
কেন? কী আছে গ্লাসে?
কোনো জবাব পাওয়া গেল না। তখন সেও মরে গিয়ে গ্লাসটা আবার হাতে নিল। ভাবলো, তবে কি তার স্ত্রী চায় না সে সুরা পান করে? তা যদি হয়, তাহলে মেয়েটার চোখে আতঙ্ক কেন?
জগতে তেত্রিশ বছর বাস করছে পীরজাদা। আবার সে টাই বাধলো গলায়, জুতো পরল, জ্যাকেট চাপালো এবং গ্লাস থেকে সম্পূর্ণ পানীয় একটা শিশিতে ঢেলে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেল।
রাত সাড়ে দশটায় অবসন্ন হৃদয় নিয়ে ফিরলো পীরজাদা। হুইস্কিতে বিষ মেশানো ছিল। তার বন্ধু এক ডাক্তার ছিল। ল্যাবরেটরীতে বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেল। খবরটা পেয়ে পীরজাদার মনে হয়েছিল, এখন আবার সে সম্পূর্ণ গ্লাসটা পেলে পান করে ফেলতে পারত। যেন অনুতাপও হলো তখন তা করেনি বলে। তাকে হত্যা করতে চেয়েছে তার স্ত্রী এ সত্য না স্বপ্ন? কেন তাকে সে হত্যা করতে চাইবে? কেন? টলতে টলতে বাড়ি ফিরল সে।
ফিরে দেখল ঘর শূন্য, স্ত্রী নেই। এটাও যেন আশা করা গিয়েছিল। বিস্ময় তাকে আলোড়িত করতে পারল না। সে রাতে সারা রাত সুরা পান করল পীরজাদা।
দুদিন পরে সন্ধ্যার সংবাদপত্রে এক খবর ছাপা হলো যার সারমর্ম জনৈক ভদ্রমহিলা করাচি থেকে রাতের ট্রেনে পেশোয়ার যাচ্ছিলেন জনৈক পুরুষ সঙ্গীর সঙ্গে। পথিমধ্যে ভদ্রমহিলা দারুণ বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ব্যাধির প্রকোপ অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। তার পুরুষ সঙ্গীটির কোন সন্ধান পাওয়া যায় না। ভদ্রমহিলা এক স্টেশনের বারান্দায় প্রাণত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তিনি তার নাম বলেন বেগম পীরজাদা।
খবরটা বিদ্যুতের মতো স্পর্শ করলো পীরজাদার বন্ধুমহলকে। তারা টেলিফোন করল, দেখা করতে এলো, খুঁজে বেড়াল পীরজাদাকে। কিন্তু এত কাণ্ড যাকে নিয়ে তাকেই খুঁজে পাওয়া গেল না। একমাস পর পীরজাদাকে আবার হঠাৎ দেখা গেল করাচিতে। তখন সে সম্পূর্ণ অন্য মানুষ। এই একটা মাস সে কোথায় ছিল তা জানা গেল না। বন্ধুদের সে বর্জন করলো, বান্ধবীদের সতেরো হাত দূরে রাখল। বাসা তুলে দিলো। উঠে এলো হোটেল কোলামবাসে। প্রথমে তার মনে হয়েছিল বুঝি খুব কষ্ট হবে, কিন্তু কই তাতো হলো না। বরং যেন তার মনে লেগেছে অস্বাভাবিক এক মুক্তির রঙ। এ এমন এক মুক্তি যেন জীবন চলছিল এতক্ষণ সিনেমা হলে শাদা কালো ছোট পর্দার ছবির মাপে, হঠাৎ পর্দা প্রশস্ত হয়ে গেল—-শাদা কালোর বদলে রং দেখা দিল।
আসলে এটাই হচ্ছে পীরজাদার কষ্টের রূপ। একেকটা মানুষের কষ্টের ছবি একেক রকম। এ লোকটা নিজে সচেতন নয় তার কষ্ট এসেছে এই ভাবে। ওটাতো মুক্তি নয়, ও হচ্ছে মৃত্যু। হোটেল কোলামবাসের তেতলায় সর্বদক্ষিণের ঘরে আজ আড়াই বছর ধরে যে মানুষটা থাকে, তাকে দেখে এখন আর এসব কল্পনাও করা যাবে না। এখন, আগেই বলা হয়েছে, সে যদ্দিন না মাটির তলায় যাচ্ছে তদ্দিন নিজেকে মাটির ওপর বাঁচিয়ে রেখে চলেছে।
২. পীরজাদার ইনভাইটেশন ছিল
পীরজাদার ইনভাইটেশন ছিল তার এক ক্লায়েন্টের বাড়িতে। ক্লায়েন্ট ভদ্রলোকের মেজ মেয়ের জন্মদিন। তাকে কিছু মূল্যবান অলঙ্কার উপহার দেয়া গেল। সর্ব অঙ্গে যৌবন বিচ্ছুরিত মেয়েটা ভারী খুশি হয়েছে ছবিটা এখনো চোখে ভাসছে তার। যে কেউ মনে করতে পারতো উপহারের এই বহর দেখে যে, পীরজাদার চোখ পড়েছে মেয়েটির ওপর। হ্যত তারা মনে করেছেও। পীরজাদার চেয়ে আর কে ভালো জানে এটা হচ্ছে তার ঘৃণার একটা প্রকাশ। যে কোন নিয়ম, নিয়মের কথা শুনলে পীরজাদার আজকাল গা জ্বালা করতে থাকে। তখন সর্বস্ব পণ করে তার ওপর কিশতি মাৎ করতে তৎপর হয়ে ওঠে সে। জন্মদিনে। উপহার দেয়াটা একটা নিয়ম। এ নিয়ম বদলাতে পারবে না পীরজাদা। আর তাই যেন জেদ করে মূল্যবান এক উপহার ছুঁড়ে ফেলে ক্রোধ নেভানো। উপহারটা দিয়েই বেরিয়ে এসেছে সে। এসে বসেছিল একবারে সুরা পান করতে। যখন উঠল, রাত তিনটে। মোড়ের বুড়ো ঝাকড়া গাছটার নিচে ছায়া ছমছম করছে। মনে হচ্ছে শহর থেকে সমস্ত লোক পালিয়ে গেছে মহামারীর ভয়ে।