যে পীরজাদা সুন্দরী তরুণী দেখলে শিউরে উঠত, মনে মনে এবং কখনো কখনো সরবে তাদের গাল দিত বাস্টার্ড, হাসি, বেশ্যা বলে সেই পীরজাদা যখন এই সব রাতে বারান্দায় বেরিয়ে এসে ঐ আলোর মধ্যে নিকষ কালো কল্পনার মহিলাকে দেখতে পেত তখন তার মনে হতো ভেতর থেকে বুক খালি করে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছে। মাথার মধ্যে তখন সুরার সেতার বাজছে। সে রেলিং–এ ঝুঁকে পড়ে প্রলাপ বকতো আর কাঁদতো।
বন্ধুদের রীতিমত শক্তি প্রয়োগ করতে হতো পীরজাদাকে তখন বারান্দা থেকে ঘরে আনতে। এটা একটা নিয়ম হয়ে গিয়েছিল, সুরা পানের আসর থেকে পীরজাদাকে কেউ একা বারান্দায়। বেরুতে দিত না। তাকে চোখে চোখে রাখা হতো।
কিন্তু যারা পাহারা দেবে তারাও তো মদ খেতেই বসেছে। তাদের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গেলে। কে আর কাকে রাখবে চোখে? তখন পীরজাদা বেরুতো বারান্দায়। আর ঘটতো এই কান্ড। নিচে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে ভয়ে তার শরীর হিম হয়ে যেত। কারণ তার মনে হতো, পীরজাদা বুঝি রেলিং থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করবার চেষ্টা করছে।
অবশ্যি সে ইচ্ছে থাকলে আজ থেকে আড়াই বছর আগেই সব শেষ হয়ে যেত। তার কবরের পরে ঘাসের শীষ ঘন হয়ে উঠত এতদিনে। তবে সুদর্শন অগ্নিসম্ভব গায়ের রং, কয়লা রং স্যুট পরা, নীল চোখ, দীর্ঘ এই মানুষটাকে জীবিত বলাও ভুল। কারণ, পীরজাদা মনে মনে জানে তার বেঁচে থাকার এখন একটি মাত্রই উদ্দেশ্য, আর তা হচ্ছে এই ছফুট দেড় ইঞ্চি দীর্ঘ লাশটা যদ্দিন না মাটির তলায় যাচ্ছে তদ্দিন মাটির ওপরে তাকে বাঁচিয়ে রাখা। আর সম্ভবত তাই নিয়ম বা অনিয়মের ভেদাভেদ নেই তার কাছে। রাত চারটেয় তার শোবার সময়, দুপুর এগারোটায় ব্রেকফাস্ট, তিনটেয় লাঞ্চ, ডিনারের কথা কোনদিন মনে থাকে কোনদিন থাকে না। সাতদিন অফিসে ভূতের মতো কাজ করতে পারে এক লহমার বিশ্রাম না নিয়ে, আবার তিনদিন একটানা ঘুম থেকে বুঝি আজরাইলও টেনে তুলতে পারবে না। মদ স্পর্শ করবে না মাসের পর মাস, আবার বসলে বড় একটা বোতল বিরতিহীন পান করে কারো সাহায্য না নিয়ে নিচ তলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে তেতলায় উঠে অন্ধকারে চাবি দিয়ে ঘরের তালা খুলে পোশাক বদলে ঘুমোতে যেতে পারে একটুও না টলে, ভুল না করে।
এর শুরু সেই আড়াই বছর আগে।
তারো তিন বছর আগের কথা। পীরজাদা তখন সদ্য বিলেত ফেরত, চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্সীতে সাফল্যের সঙ্গে ওত্রানো ছেলে। দেশে ফিরে চাকরি নিল না। বাবা বললেন, আমি টাকা দিচ্ছি, তুমি ফার্ম করো। বাবাকে একালের ছেলেদের চেয়ে একটু বেশি শ্রদ্ধা করতে পীরজাদা। চাকরির অফারটা ছিল ভালো। কিন্তু সেটা তক্ষুনি ফেরৎ পাঠিয়ে ফার্ম করার জন্যে উঠে পড়ে লাগল সে।
কয়েক মাস পর সুদূর গুজরানওয়ালা থেকে বাবা লিখলেন, আমার শরীর অত্যন্ত খারাপ। আশঙ্কা হচ্ছে বাচবো না। তুমি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছ এবং ইতিমধ্যে অনেকখানি। প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছ এটা পিতা হিসেবে আমার পরম আনন্দের কারণ। কিন্তু তবু বলবো, এ আনন্দ সম্পূর্ণ নয়। তুমি সংসারী হও। পুত্রবধূর মুখ না দেখে মরলে বেহেস্তে গিয়েও শান্তি পাবো না। তোমার ওপর আমার অসীম আস্থা আছে। আমি একটি সুলক্ষণা, সর্বগুণসম্পন্না, সুন্দরী পাত্রীর সঙ্গে তোমার বিবাহ স্থির করেছি। পত্র পাওয়া মাত্র বাড়ি চলে এসো। আগামী বৃহস্পতিবার রাত্রে শুভদিন ধার্য হয়েছে।
পীরজাদা এলো গুজরানওয়ালায় সেই রাতেই ট্রেন ধরে। এবং যথানিয়মে বৃহস্পতিবারও এলো। পরিবারের বড় ছেলের বিয়েতে তিনদিন তিনরাত রোশনাই হয়ে থাকল সারা মহল্লা। চতুর্থদিনে পীরজাদা বউ নিয়ে ফিরলো করাচি। সুন্দরী সন্দেহ নেই, কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য জগতের মেয়ে।
পীরজাদার বাবা সন্ধান রাখতেন না, তার ছেলের জীবনে পরিবেশের কতখানি পরিবর্তন হয়েছে ছবছর বিলেত বাসের ফলে। যে সুলক্ষণা মেয়েটিকে তিনি ছেলের জীবনসঙ্গিনী করে দিলেন, সে সলাজ, সন্ত্রস্ত এক গেঁয়ো বালিকা। পীরজাদা যে সমস্ত বান্ধবীদের সঙ্গ পেয়ে অভ্যস্ত তাদের কলরব মুখরিত বিদ্যুৎ চমকিত উপস্থিতির পাশে এ মেয়ে যেন মাটির প্রদীপ। প্রথম কদিন স্তব্ধ হয়ে রইলো লোকটা। এমন কী একে আত্মনির্বাসনও বলা যেতে পারে। প্রায় এক পক্ষকাল করাচিতে থেকেও পীরজাদার সাক্ষাৎ তো দূরে থাক তার সিগারেটের ছাইটুকু পর্যন্ত কেউ দেখতে পেল না। একদিন বিকেলে তার কয়েকজন বন্ধু, বন্ধুপত্নী আর একজোট অবিবাহিত বান্ধবী এসে অতর্কিতে বাসায় চড়াও হলো। সমস্বরে তারা বলল, কী এমন বউ পেয়েছ যে বাসা থেকে বেরুতেও চাও না? আমরা দেবী দর্শনে এসেছি।
লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে গেল পীরজাদা। এদের সামনে ঐ স্বল্পশিক্ষিতা, এক শতাব্দী পেছনে পড়ে থাকা, প্রচুর পোশাকে প্রায় সম্পূর্ণ আবৃতা তার স্ত্রীকে কী করে সে বার করবে? তার বান্ধবীদের চোখে যে দীপ্তি জ্বলছে, পীরজাদার মনে হলো, তা প্রস্তুত হয়ে আছে। উপহাসের জন্যে। পীরজাদাকে সেদিন গলদঘর্ম হতে হয়েছিল উদগ্রীব মানুষগুলোকে নিরস্ত করতে। শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে তাদের তো পাঠানো গেল। এবং প্রতিজ্ঞা করতে হলো অদূর ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই স্ত্রীকে সে হাজির করবে তাদের দরবারে।
বলতে গেলে সে রাত থেকেই স্ত্রীকে আধুনিকা করবার জন্যে উঠে পড়ে লেগে গেল লোকটা। পীরজাদার একটা স্বভাব যখন যে কাজ করবে নিঃশ্বাস না নিয়ে করা চাই, আর যতক্ষণ না শেষ হচ্ছে ততক্ষণ স্বস্তি নেই। স্ত্রীর কোন ওজর আপত্তি টিকলো না, ঘরের কাজ মাথায় উঠলো রান্নাবান্না পড়ে রইলো, বসে বসে সে মুখস্ত করতে লাগলো সামাজিক কেতা–কানুনেব বুলি, নতুন ধরনের কাটা কামিজ পরে অস্বস্তির সঙ্গে শুরু হলো তার চলাফেরা, এক ফালি দোপাট্টায় শরীর বিব্রত হয়ে রইল, মুখে নানা রঙের সমাবেশ মুখোশের মতো যন্ত্রণার সৃষ্টি করলো, নাক জ্বালা করতে থাকল সুরার গন্ধে, বাথ সলটে বমি। কিন্তু মাত্র দিন সাতেকের জন্যে।