বাসার কথাটা অজান্তে মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে মহসিনের। তার বাসা কোথায়? তার বাসা তো পথ। কিন্তু রজনীকে বুকের মধ্যে নিয়ে, তার কান্নার জন্যে মিথ্যে ছাড়া আর কিছুতে সান্ত্বনা দেয়ার কথা সে ভাবতে পারল না।
নিজেকে মুক্ত করে রজনী বলল, চলো, আমাকে এখুনি নিয়ে যাও।
মহসিন হাত ধরলো তার। দৃপ্ত ভঙ্গিতে রজনী সিঁড়ির দিকে এগুলো। খোলা দরোজা পড়ে রইল খোলা। মহসিন তাকে নিরস্ত করবার মতো সাহস পেল না খুঁজে। কেবল বলল, তাই চলো।
.
তখন যদি ওরা একবার পেছনে ফিরে তাকাতো, দেখতে পেতো, একেবারে দক্ষিণে বাতি নেভানো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সারাক্ষণ একটা মানুষ তাদের দেখছিল। সে লোকটা দেখেছে রজনী মহসিনের আলিঙ্গনে বাঁধা। দৃশ্যটা চোখে পড়তেই তার হৃদয়ে তীরবিদ্ধ হবার যন্ত্রণা হয়েছিল। মুমূর্ষ মানুষের মতো সে তাকিয়ে দেখেছে ওদের। তাকিয়ে দেখেছে রজনীকে। দেখেছে মহসিনের সঙ্গে তাকে চলে যেতে।
যেন তার জীবন থেকে অপসারিত হলো সূর্য।
রজনী চলে গেলে পীরজাদা তার ঘরে এসে দাঁড়াল। মাথা নত করে কী ভাবলো অনেকক্ষণ ধরে। এ কসপ্তাহ রজনীকে সে এড়িয়ে যেতে চেয়েছে, আজ রজনী যখন নিজেই চলে গেল তখন হৃদয় ধাবিত হলো তারই দিকে। কিছুতেই ফেরানো যাচ্ছে না। অথচ রজনীকে অবাধে যেতে দিতে হয়েছে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থেকে মৃত একটা মানুষের মতো নিশ্চলতা নিয়ে সে দেখেছে তাদের দুজনকে।
দ্রুত একটা চিঠি লিখল পীরজাদা। সেটা লালা স্বরাজের ঘরে পৌঁছে দেয়ার জন্যে বেয়ারার হাতে দিল। তারপর দরোজা বন্ধ করে আলমিরা খুলে দেখল চার বোতল হুইস্কি এখনো আছে। নামিয়ে আনলো বোতল চারটে। টেবিলের ওপর পাশাপাশি রেখে খুললো সব কটার মুখ। নিভিয়ে দিল বাতি। তখন বাইরের অস্পষ্ট আলো ঘরের মধ্যে বেলে জ্যোছনার মতো ছড়িয়ে পড়ল লাফিয়ে। তখন উন্মত্তের মতো মাথা পেছনে ঠেলে হাঁ করে একটার পর একটা বোতল থেকে পান করতে লাগল ঢকঢক করে।
.
শবদাহ করে সকাল নটার সময় হোটেলে ফিরল লালা স্বরাজ। এসে সোজা গেল রজনীর ঘরে। দরোজা ঠেলে দেখল, তালা বন্ধ। নিচে নেমে এসে শুনলো, কাল সন্ধ্যের সময় সে চলে গেছে।
কোথায়?
বলতে পারল না কেউ। ম্যানেজারেব কাছে জিগ্যেস করেও কোনো লাভ হলো না। কেবল এইটুকু শোনা গেল, মহসিনের সঙ্গে গেছে রজনী। নিজেকে তখন ভীষণ নিঃসঙ্গ মনে হলো তার। পৃথিবীতে এই একটা বন্ধন ছিল—- তার বাবা। তাকে দাহ করে এসে নিঃসঙ্গতা ছাড়া আর কোনো অনুভূতি অবশিষ্ট নেই।
নিজের ঘরে এসে দেখল, মেঝেয় একটা চিঠি। হয়ত রজনীর চিঠি। হাতে নিয়ে পীরজাদার হাতের লেখা চোখে পড়ল তার।
স্বরাজ, বন্ধুত্বের অনেক ঋণে তুমি আমাকে আবদ্ধ করেছ। আজ একটা অনুরোধ করব। আমি হয়ত মরতে যাচ্ছি, আমার দেহ তুমি গুজরানওয়ালায় পাঠিয়ে দাও। তোমার কল্যাণ হোক।
বোকার মতো চিঠিটার দিকে তাকিয়ে রইলো স্বরাজ। দৌড়ে তেতলায় এসে পীরজাদার দরোজা ঠেলে দেখে ভেতর থেকে বন্ধ। উন্মত্তের মতো আঘাত করতে লাগল সে দরোজায়। ভেতর থেকে খুলে দিল না কেউ। আবার সে আঘাত করল, আবার, আবারও।
ম্যানেজারকে ডেকে এনে দরোজা খুলে লাশ বার করা হলো পীরজাদার। মেঝের পরে শূন্য চারটে বোতল। প্রাণহীন নিস্পন্দ দেহ লুটিয়ে ছিলো পা সোফায়, মাথা মেঝেয়, চোখ বিস্ফারিত, মুখে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের একত্রিত এক অর্থহীন অসীম বিরক্তি। আর কিছু না। লালা স্বরাজ একদিনে দেখল দুটি মৃত্যু, আর একটি মানুষের হারিয়ে যাওয়া। বুকের পরে ক্রশ করতে ভুলে গেল সে এবার।
সেদিন রাতে সে অফিসে বসে সংবাদ লিখল তার টাইপরাইটারে—-কাল রাতে ঘুমের মধ্যে হার্টফেল করে মারা গেছে পীরজাদা।
যে লোকটার জীবন ছিল বিড়ম্বিত, যে লোকটা ছিল তার বন্ধুদের অসীম করুণার পাত্র, সে আত্মহত্যা করেছে এ সংবাদ ছেপে তাকে আরো করুণার পাত্র করতে পারলো না লালা। স্বরাজ। টাইপ শেষ করতে করতে দেখল, ভালো করে আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। আচমকা চোখে হাত দিয়ে দেখল, চোখ পানিতে ভরে আছে। সম্ভবত লালা স্বরাজ ছিল পীরজাদার একমাত্র বন্ধু।
করাচী, পাকিস্তান
১৯৬৩