রাত নটার সময় পরিপূর্ণ চোখ মেলল দশরথ। দেখল, একটি অপরিচিত মুখ। কোমরের নিচ থেকে সব শূন্য লাগছে, কোথায় যেন যন্ত্রণা হচ্ছে বুঝতে পারা যাচ্ছে না, মাথার মধ্যে চোখে দেখা সব কিছু টলছে, স্থির হয়ে আবার টলছে।
সে বলল, বাবা, আমি স্বরাজ।
কে?
দশরথের কাছে দূর থেকে চেনা মনে হলো নামটা। যেন বহুঁকাল আগে ভিড়ের মধ্যে কোথাও শুনেছিল। অজান্তে তার হাতটা উঠে এলো, কাঁপতে কাঁপতে স্পর্শ করল স্বরাজের চোখের কোল।
স্বরাজের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। সে অশ্রু দশরথের শিথিল আঙুলের ডগা সিক্ত করে দিল। আলোর প্রতিফলনে একখন্ড দীপ্তি হয়ে উঠলো সে অংশটুকু। হাতটা পড়ে গেল। বিছানার পরে। লালা স্বরাজ সে হাত তার আকুল মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলল, বাবা, বাবা, তুমি শুনছ, তুমি চিনতে পারছ না? বাবা, আমি স্বরাজ। আমি স্বরাজ। আমি রাগ করে চলে গিয়েছিলাম। বাবা, আমি স্বরাজ।
দশরথ তার কণ্ঠ শুনল কিনা বোঝা গেল না। কোন প্রতিক্রিয়া হলো না তার মুখে। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে কেবল এপাশ ওপাশ করবাব ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগল। আধ ঘণ্টা পরে আবার রক্তক্ষরণ শুরু হলো।
তখন তাকে নিয়ে যাওয়া হলো অপারেশন কামরায়। বাইরে দাঁড়িয়ে রইলো স্বরাজ। অস্থির পদচারণা করতে করতে সে জেসাসের ছবি মনে করবার চেষ্টা করল। পাগলের মতো প্রার্থনা করতে লাগল। দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে ঈশ্বরের সিংহাসন টলিয়ে দশরথের জীবন ভিক্ষা সে চাইলো। মুহুর্মুহ উত্তর্ণ হয়ে উঠলো। আবার সে প্রার্থনা করল।
আবার তাকে নিয়ে আসা হলো বেডে। দশরথ যেন পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। ডাক্তারের দিকে চোখ তুলে স্বরাজ তাকাতেই সে বলল, এখনো বেঁচে আছেন। আমরা চেষ্টা করছি।
আশান্বিত হয়ে সারারাত বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে জেগে রইলো স্বরাজ। আশা, কখন চোখ মেলে সে ছেলেকে চিনতে পারবে।
রাত চারটে ছাপ্পান্ন মিনিটে ঘুমের মধ্যে মারা গেল দশরথ। যন্ত্রের মতো বুকে ক্রশ করলো লালা স্বরাজ। তবু বিশ্বাস হলো না। তবু যেন আশা ফুরাতে চায় না। নার্স দেহটাকে যখন কম্বলে ঢেকে দিল তখন সে উঠে দাঁড়িয়ে মনে মনে প্রার্থনা করলো।
আমার পিতাকে তুমি স্বর্গে নিও, যেমন তুমি সবাইকে তোমার অসীম ক্ষমার মধ্য দিয়ে স্বর্গে নেবে। আমরা যারা জীবিত, আমাদের যেন অহংকার না হয়। একমাত্র তোমার নিকটেই সান্ত্বনা। তোমারই এ রাজ্য, সর্বক্ষমতা, সর্বগৌরব। আমেন।
.
আর রজনী? সারাটা দিন সে প্রতীক্ষা করল স্বরাজের জন্যে। দশটা বেজে গেল তবু সে এলো না, তখন তার প্রসাধনে প্রস্তুত দেহ, অনুভবে সম্পন্ন হৃদয়, আশঙ্কায় কেঁপে উঠলো। ভাবলো এই হয়ত সে এসে যাবে, রাজার মতো এসে দাঁড়াবে স্বরাজ তার দুয়ারে। লজ্জা করল, নিজে গিয়ে খবর নিতে। সে যে আজ বিয়ের কনে।
এগারোটা পেরিয়ে গেল তবু যখন স্বরাজ আসেনি, তখন সে কম্পিত চরণে নিচে নেমে দেখে ননম্বর কামরা বন্ধ। বুকের মধ্যে আগুনের মোহর পড়লো যেন তার। স্বরাজ যে কাগজে কাজ করে সেখানে টেলিফোন করে সন্ধান পাওয়া গেল না। তাড়াতাড়ি ওপরে এসে নিজের ঘরে বসে বুকের পরে হাত রেখে আত্মস্থ হবার চেষ্টা করল রজনী। স্বরাজ কি শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পালটে পালিয়ে গেল মহসিনের মতো? নিজের পোড়া কপালটার কথা মনে করে পাগলের মতো হেসে উঠতে ইচ্ছে হলো তার। ইচ্ছেটা এত তীব্র, হৃদপিণ্ড ফেটে পড়বে যেন।
বুড়ো পাঠান এসে জানিয়ে গেল, সাহেব বাইরে গেছেন, বলে গেছেন একটু পরেই ফিরবেন। তার কথা কানেও গেল না রজনীর। স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো সে। মলিন হতে লাগল তার মুখের রং। খসে পড়ল কপালের কুঙ্কুম। পাণ্ডুর হলো কবরীর মোতিয়া–মালা। বেলা গেল, তবু স্বরাজ এলো না।
কিসসু ভাবতে পারল না মেয়েটা। ভাবনার উৎস যেন তার বিকল হয়ে গেছে। ইন্দ্রিয় হয়েছে পাথব। যেমন বসে ছিল তেমনি বসে রইলো। না অতীত, না বর্তমান, না ভবিষ্যৎ কিছুই তাকে বিচলিত করতে পারল না।
সন্ধ্যের ঠিক আগে যখন সমস্ত ঘরটা একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছিল অন্ধকারে, আর রজনীর মনে হচ্ছিল তার মৃত্যু হচ্ছে, ঠিক তখন দরোজায় টোকা পড়ল।
হৃদয় লাফিয়ে উঠলো দুরাশায়। দরোজা খুলে দেখল, মহসিন।
মহসিন। দুয়ার খুলে চেনা এই লোকটার মুখ একেবারে রজনীর চোখে দুর্বার তরঙ্গের মতো আছড়ে পড়লো যেন।
এক মুহূর্তে কী হলো তার মনের মধ্যে, মহসিনের বুকের পরে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে বেষ্টন করে তাকে দুহাতে আঘাত করতে করতে অশ্রু জড়ানো বিকৃত কণ্ঠে সে বলতে লাগল, তুমি আমার শত্রু। আমাকে কেন ভালবাসলে? কেন চলে গেলে?
বিহ্বল হয়ে গেল মহসিন। রিক্ত, সর্বস্বান্ত, বিপন্ন অস্তিত্ত্ব এই লোকটা কিসসু বুঝতে পারল না। রজনীর খোলা এলো চুল, বিস্ফারিত চোখ দেখে সে ভয় পেলো, অপরাধী বোধ করল নিজেকে। আজো সে টাকা নিতে এসেছিল রজনীর কাছ থেকে। রজনীর ওপর দিয়েই দুঃখের দিনগুলো পার হবে ভেবেছিল। কিন্তু তা তলিয়ে গেল কোথায়। সেদিন যে বিশ্রী কথাগুলো রজনীকে বলেছিল, সেটা তো ছিল তার পালিয়ে যাওয়ার পর প্রথম আবির্ভাবের সংকোচ আর অপরাধের বিরুদ্ধে একটা বর্ম। আজ সে বর্ম ভেঙ্গে গেল খানখান হয়ে। সে খোলা দরোজার মুখে রজনীকে বুকের ভেতর আঁকড়ে ধরে উচ্চারণ করল, রজনী, আমি বাসা করেছি, আমি তোমাকে নিতে এসেছি। আমি আর কোথাও যাবো না, রজনী।