গোসল করে এসে চা খেতে খেতে সকালের কাগজ পড়ছিল সে। আজ তার মন বসছিল না। কোন সংবাদে। চঞ্চল চোখ এ পাতা ও পাতায় ভেসে বেড়াচ্ছিল, একই লেখা সতেরোবার দেখছিল। এমন সময় হঠাৎ চোখে পড়ল ছোট্ট একটি সংবাদ। সে সংবাদে লেখা, গতকাল বিকেলে করাচিতে আসছিল হায়দ্রাবাদ থেকে লোকাল। তার পাদানি থেকে ফসকে পড়ে দশরথ নামে আনুমানিক পয়ষট্টি বৎসরের এক দরিদ্র বৃদ্ধ হরিজন গুরুতর রূপে আহত হয়েছে। তাকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে আশঙ্কাজনক অবস্থায়।
লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল স্বরাজ। দশরথ? দশরথ যে তার বাবার নাম
যে বাবাকে ফেলে সে ছোটবেলায় পালিয়ে গিয়েছিল, যে বাবাকে সে গত পাঁচ বছর ধরে করাচির বস্তিতে বস্তিতে খুঁজে বেরিয়েছে। তার বাবা বেঁচে থাকলে তো আজ পঁয়ষট্টি বছর বয়সের হতেন। তিনিই কি আসছিলেন হায়দ্রাবাদ থেকে? উত্তেজনায় সারা শরীর কেঁপে উঠলো লালা স্বরাজের। কিন্তু কিছুতেই বিচলিত হওয়া স্বভাব নয় তার। এ বৃদ্ধ তার বাবা নাও হতে পারেন। দশরথ নামে রামায়ণের যুগ থেকে আজ অবধি কোটি কোটি মানুষ জন্ম নিয়েছে।
তবু দুর্ঘটনার কথা শুনে তার মনের মধ্যে কেমন করে উঠলো। কী জানি হয়ত হাতের কাছে এসে হারিয়ে যাবে। তবু তো নামের মিল রয়েছে, এ মিলটুকুও সে গত পাঁচ বছরে খুঁজে পায়নি।
ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল সাতটা বাজে। আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসা যাবে। হয়ত রজনী এখনো ঘুম থেকেই ওঠেনি।
পোশাক পরে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল সে হোটেল থেকে। বুড়ো পাঠান পোর্টারের সঙ্গে দেখা হলো সিঁড়ির মুখে। তাকে বলল, মেম সাহেব আমার কথা জিগ্যেস করলে বোলো আমি এক্ষুণি আসছি।
সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া গেল না স্কুটার, ট্যাকসি। একটা টাঙ্গা যাচ্ছিল। সেটাকে থামিয়ে উঠলো। স্বরাজ। কিছু দূরে গিয়ে একটা খালি ট্যাসি চোখে পড়তেই চিৎকার করে সেটা থামাল। বসলো তাতে। ট্যাসি ছুটে চলল রেলওয়ে হাসপাতালের দিকে।
হাসপাতালে এ সময় ভিজিটর আসা নিষেধ। তার সাংবাদিক কার্ড দেখিয়ে মুক্তি পাওয়া গেল। খোঁজ পেতে পেতে লাগল মিনিট পনেরো। অবশেষে তেতলার এক চার–বেড। কামরায় তাকে নিয়ে এলো ওয়ার্ডেন।
দরোজায় পা দিয়েই লালা স্বরাজ দেখল বেড খালি। আসলে তিনটে বেড খালি ছিল, সেই তিনটেই আগে চোখে পড়েছে তার। আবার যখন ভালো করে তাকাল, দেখল, ডান দিকের বেডে ফিরে শোয়া একটি দেহ। সমস্ত দেহ কম্বলে ঢাকা। মুখের যতটুকু প্রকাশিত কেবল। শাদা চুল দেখা যাচ্ছে। তার শরীর এমন শান্তিতে ডুবে আছে যে এ কেবল অধিক মর্ফিয়াতেই সম্ভব।
ডাক্তার জানাল, একটা পা হাঁটুর ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, রক্তক্ষরণ হচ্ছে প্রচুর।
লালা স্বরাজ ধীরে ধীরে বেডের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আস্তে আস্তে ঝুঁকে পড়ে চেষ্টা করল তার মুখ দেখতে। ভালো করে দেখা গেল না। তখন সে ঘুরে তার ফেরানো মুখের সমুখে। এসে দাঁড়াল।
একটা পলক। কিসসু দেখতে পেল না স্বরাজ। কিংবা দেখল পথে ঘাটে দেখা হাজার হাজার ধাঙড় ঝাড়ুদার ভিখিরিদের একটা মুখ। হৃদয় স্তব্ধ হয়ে গেল তার। পরক্ষণে একপাল ঘোড়ার পদক্ষেপে বিচূর্ণ হতে থাকল তার সমস্ত অনুভূতি। সেই মুখ, চিবুকের নিচে সেই গভীর কাটা দাগ, গলায় সেই রূপোর মাদুলি! তার বাবা। তার ঝাড়ুদার বাবা, যে বাবাকে সে খুঁজে বেরিয়েছে পাঁচটি বছর। তিনি শুয়ে আছেন মর্ফিয়ার আচ্ছন্ন করা ঘুমে। কালো ত্বক বয়সের ভারে আরো কালো হয়েছে, কুঞ্চনে ভরে গেছে মুখ, চিবুকের হাড় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আরো। পলকহীন চোখে তাকিয়ে রইলো পিতার দিকে সন্তান। যেন পঁচিশ বছরের অদর্শনের বিরাট ফাঁক কয়েক মুহূর্তের হাহাকার ভরা দৃষ্টিতে ভরে তুলেছে স্বরাজ। সে একবার হাত রাখতে গেল জ্ঞানহীন দশরথের শরীরে, ফিরিয়ে আনল, বিমূঢ়ের মতো তাকাল চারদিকে। কোনো রকমে ডাক্তারকে বলতে পারল, বাঁচবেন?
এখনো বলা যাচ্ছে না। কে লোকটা? ডাক্তার স্বরাজকে দেখে নিয়ে আবার শুধালো, আপনার বাড়িতে কাজটাজ করত নাকি?
শুনে তার ভীষণ ক্রোধ হলো। চমকে উঠলো সারাটা অন্তর। নিজেকে সংযত করে চোয়ালের হাড় দৃঢ় করে সে উচ্চারণ করল, আমার বাবা।
ও মাই গড। অস্কুট বিস্ময়–ধ্বনি বেরুলো ডাক্তারের কণ্ঠ থেকে। অবাক হয়ে সে একবার পিতার দিকে দেখল, একবার পুত্রের দিকে।
আধঘন্টার মধ্যে হোটেলে ফিরতে চেয়েছিল স্বরাজ। কিন্তু হোটেলের কথা তার আর মনে রইলো না। মনে পড়ল না রজনীর কথা। আজ দশটার সময় তার বিয়ে, রজনী তার জন্যে। তৈরি হয়ে বসে থাকবে—- এসব কিছুই যেন তার জীবনে ঘটবার কথা ছিল না। সে নিষ্পলক বসে রইলো দশরথের পাশে। ডাক্তার আসছে, যাচ্ছে, নার্স সেবা করছে, ওষুধ দিচ্ছে, ইনজেকশান হচ্ছে ছবির মতো সব ঘটে যাচ্ছে তার চোখের সমুখে। একটা শব্দ তার। কানে যাচ্ছে না। ওদের একটা কথার মানে সে বুঝতে পারছে না।
সারাটা দিন বসে রইলো সেখানে। নাওয়া–খাওয়া কিছুই হলো না। কেবল মনে হলো, সে উঠে গেলেই ফাঁকি দিয়ে তার বাবা স্বর্গে যাত্রা করবেন। যেন সে বসে আছে বলেই এখনো তার মৃত্যু সম্ভব হচ্ছে না।
বিকেলের দিকে একটু জ্ঞান হলো দশরথের। যেন একবার চোখ মেলল। উদগ্রীব হয়ে স্বরাজ ডাকল, বাবা। চোখ বন্ধ করল দশরথ। সে শুনতেও পেল না। আবার সে ডাকল, বাবা।