ঠোঁট থেকে ঠোঁট বিচ্ছিন্ন করে রজনী তার কাঁধের পর মুখ রেখে দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলল। স্বরাজ বাহু দিয়ে তাকে বেষ্টিত করে কোনো কথা না বলে তাকিয়ে রইলো দ্রুত অপসৃয়মাণ দালান ল্যাম্পপোস্ট ফুটপাথের দিকে। যেন তারা ঝড়ের মধ্য দিয়ে অতি নিরাপদে একটা জাহাজে চড়ে দূরে কোথাও যাচ্ছে।
ডানে, ডান দিকে যাও।
রজনী চোখ বুজে শুনলো স্বরাজ তাদের ট্যাসিকে থেকে থেকে নির্দেশ দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর রজনীকে জড়ো করে তুলে সে বলল, দ্যাখো।
রজনী তাকিয়ে দেখে তারা চওড়া নির্জন রাস্তা দিয়ে দুধারে অগুনতি প্রাসাদের মতো বাড়ি ফেলে ছুটে চলেছে। আকাশে অনেক তারা উঠেছে। স্বরাজ বলল, এটা হচ্ছে শহিদ—এ–মিল্লাত রোড, বন্দর রোড থেকে ড্রিগ রোডে গিয়ে পড়েছে। সমুখে দ্যাখো, যা তোমাকে দেখাবো বলেছিলাম, আসছে।
পাথরের উঁচু নিচু অসমতল কেটে গড়ে উঠেছে সারাটা এলাকা। ট্যাসি ছুটছে বাতাস কেটে। দৃশ্যপটের মতো তারায় ভরা আকাশ নেবে এসেছে উইণ্ডস্ক্রীন ভরে। দুদিকে অন্ধকার। যেন সোজা ছুটে চলেছে তাদের ট্যাকসি ঐ তারার দিকে।
স্বরাজ বলল, ঐ রজনী।
ঠিক সেই মুহূর্তে অপসারিত হলো আকাশ; ঘটলো ইন্দ্রজাল; নক্ষত্রের বদলে উইণ্ডস্ক্রীনের ভেতর দিয়ে দেখা গেল পায়ের নিচে আলো জ্বলা এক শহর ছবির মতো অপরূপ বিছিয়ে আছে। ঘুমিয়ে পড়া শিবিরের মতো দেখাচ্ছে। আসলে এতক্ষণ তারা যে সমতল ধরে আসছিল তা এখানে এসে হঠাৎ ঢালু হয়েছে। পাহাড়ের গা বেয়ে বানানো পথ দিয়ে নামছে তারা। সে পাহাড়ের গায়ে গায়ে উঠেছে দালান, একেবারে দূরে নিচে ঐ সানুদেশ অবধি। যেন জাদুবলে গুহার দরোজা খুলে সঞ্চিত বিক্ষিপ্ত হীরক–ঐশ্বর্যের মধ্যে গিয়ে পড়েছে তারা। যেন একটা রুদ্ধ দুয়ার কার পরশে মন্ত্রবলে গেছে খুলে। এই বিশাল দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে রজনীর হৃদয় প্রথম হলো স্তম্ভিত। পরে মনে হলো তার ভেতরটা এত বিশাল হয়ে উঠেছে যে সমস্ত পৃথিবীর, জীবনের সব ভালো–মন্দ, জয়–পরাজয়, করুণা–প্রীতি, তুচ্ছ–মহৎ সব কিছুর স্থান হবে সেখানে।
স্বরাজ বলল, এই পথটার এরূপ প্রথম যে রাতে দেখলাম, আমার ভেতরটা এত বদলে গেল, তার এক কণাও বলে বোঝাতে পারব না। মনে হলো, আমি সব পেয়েছি। আমার দুঃখ নেই, মালিন্য নেই, স্বার্থের আর্তনাদ আমার তুচ্ছ, জীবনের বিচিত্র বিরাট আমার সমুখে। যেন আমার নতুন জন্ম হলো। এমন করে আর কখনো কারু জন্ম হয়নি। যেন আমার তীর্থে আমি পৌঁছেছি। আমার ধর্মে প্রভু জেসাস যে শান্তিময় পৃথিবীর প্রতিজ্ঞা বারবার করে গেছেন, মনে হলো সে পৃথিবী আমার পায়ের নিচে, একেবারে হাতের কাছে। মনে হলো হাত বাড়িয়ে গেলেই ছুঁতে পারবো। মনে হলো, প্রতিটি দীপ আমার জন্যে জ্বলছে। মনে হলো, প্রতিটি ঘর আমার ঘর।
লালা স্বরাজের এ রূপ আগে দেখেনি রজনী। একেবাবে অন্তর থেকে হেঁকে তোলা একটা অনুভূতিকে এত কাছে থেকে এর আগে প্রত্যক্ষ করেনি সে। যেন তার হৃদয়ের মধ্যে মুখ রেখে ফিসফিস করে কথা বলছে স্বরাজ। তার সঙ্গে এতটুকু দূরত্ব নেই আর। চন্দনে কুসুমে কখন ভাগ করে নিয়েছে স্বর্গের সোনা।
স্বরাজ তার কণ্ঠের পরে হাত রেখে বলল, তুমি আমাকে বিয়ে করবে রজনী?
.
বৃহস্পতিবার তাদের বিয়ে। সে রাতের একদিন পরেই। এত তাড়াতাড়ি কিছু ছিল না, কিন্তু রজনীর প্রয়োজন ছিল। তার ভয় হচ্ছিল আবার যে কোনদিন মহসিনের আবির্ভাব ঘটতে পারে।
বিয়ের পরই তারা চলে যাবে এ হোটেল থেকে। বাসা নেবে। রজনী তার সংসার সৃষ্টি করবে। বৃহস্পতিবার সকালে কোর্টে বিয়ে হয়ে গেলে পর তারা আর ফিরবে না হোটেলে। এক ব্যবসায়ী বন্ধুর কটেজ আছে হকস বে’তে। সেখানে হবে তাদের মধুচন্দ্রিমা।
মাঝের এই একটা দিন স্বপ্নের মধ্যে কেটেছে রজনীর। এ দিনটা সে ইচ্ছে করেই দেখা করেনি লালা স্বরাজের সঙ্গে। এটা তাদের বোঝাঁপড়া হয়ে ছিলো যে, এ দিনটা আর দেখা হবে না। স্বরাজ নেবে ছুটি, নিজেকে সে প্রস্তুত করবে। আর রজনী থাকবে তার কামরায় একাকী, সেখানে সে বিশ্রাম নেবে—-আত্মার, শরীরের। দুজনের কাছেই ভারী ভালো লাগছিল এই সিদ্ধান্তটা। যেন একটা দিন দূরে থেকে, অদর্শনের মধ্য দিয়ে, পরস্পরের জন্যে অধীরতাটুকু আকাশ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছুবে।
সারাটা বুধবার শান্ত সুন্দর হয়ে রইলো রজনীর অন্তর। প্রচুর অবসর যেন তার হাতে, শ্রীমণ্ডিত নির্ভর যেন তার সমুখে, রাণীর ঐশ্বর্য তার দুহাতের মধ্যে। সকালে উঠে অনেকক্ষণ শুয়ে রইলো সে বিছানায়। কতদিন পরে গান গাইতে ইচ্ছে করল তার। ছোটবেলায় মার। মুখে গুনগুন করতে শোনা সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে ফুলডোরে বাঁধা ঝুলনা মনে পড়ে মনের মধ্যে রণিয়ে রণিয়ে উঠতে লাগল তার সুর। উঠে এসে সোফার ওপর উপুড় হয়ে অপটু গলায় অনেকক্ষণ ধরে সেটা গাইলো। শুয়ে শুয়ে খেলো ব্রেকফাস্ট। তারপর জানালা। খুলে পায়ের নিচে উজ্জ্বল ব্যস্ত শহর দেখল। পাম গাছের দীর্ঘ ছায়া খাটো হতে হতে একেবারে শেকড়ের চারপাশে এসে যখন বন্দি হলো তখন নাইতে গেল রজনী। নেয়ে উঠে নতুন স্নিগ্ধতায় ভরে উঠলো মন। দেহ থেকে প্রসাধনীর মৃদু সুবাসে আচ্ছন্ন হয়ে রইলো ইন্দ্রিয়।
বিকেলে আবার গিয়ে দাঁড়াল জানালার পারে। কোথাও বেরুবে না, তবু প্রসাধিত সজ্জিত করল নিজেকে। কাল সকাল দশটার এখনো অনেক বাকি। তবু কাল কিভাবে সজ্জা করবে, কেমন করে বেরুবে এই ভাবনা ভাবতে বসলো তার মন।
৫. খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো
খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো লালা স্বরাজের। আজ বৃহস্পতিবার। আর কঘণ্টা পরেই দশটা। এত ভোরে কোনদিন ওঠেনি সে। ঘরেই তো ফেরে রোজ রাত তিনটের আগে নয়। কাল রজনীর কথামত ছুটিতে কেটেছে। ঘুমিয়েছিল বারোটার মধ্যে। জেগে উঠে বুকের মধ্যে রিমঝিম করতে থাকল তার। স্বর্গে থাকেন বিধাতা পুরুষ। মর্তের মানুষের সঙ্গে একেক সময় তার পরিহাস করতে ইচ্ছে হয়, এরকম কথা শোনা যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে হোটেল কোলামবাসের এই ননম্বর কামরায় যা ঘটলো তাকে হয়ত দশটা মানুষ মিলে সেই পরিহাসই বলবে। কিন্তু লালা স্বরাজের কাছে তার ব্যাখ্যা অন্য রকম। ব্যাখ্যা থাক, যা ঘটলো তা এই।