রজনী মাতালের মতো টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। কোনো রকমে গলা থেকে হার খুলে হাতে দিয়ে বলল, তুমি যাও।
চট করে হারখানা পকেটে পুরে মহসিন দরোজা খুলে গলা লম্বা করে দেখল ডানে বামে। তারপর সুরুত করে বেরিয়ে গেল।
রজনী বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদতে লাগল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝি। মাথার পরে হাতের ছোঁয়া পেয়ে চোখ মেলে দেখে চোখ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে লালা স্বরাজ। এত ভালো লাগল, চোখ বুজলা, আবার। কয়েক মুহূর্ত পরে বোধ করি ফিরে আসতেই ধড়মড় করে উঠে বসলো সে। স্বরাজ বলল, দরোজায় নক করে সাড়া পেলাম না। খেতে হবে না? সাড়ে নটা রাত হয়েছে।
ম্লান হাসল রজনী। শাড়ি মুখ কুন্তল দ্রুত সংযত করতে করতে উঠে গেল। স্বরাজ বলল, সাড়া না পেয়ে হঠাৎ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম, কী হলো? দরোজা খুলে দেখি ঘুমিয়ে আছে। যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিল।
বসুন।
রজনী বাথরুমে ঢুকলো মুখ মার্জনা করতে। স্বরাজের কথা কানে বাজতে লাগল। পাশাপাশি মনে হলো মহসিনের কথা। একটা মানুম থেকে আরেকটা মানুষ কত বিপরীত পশু আর দেবতা। বেরিয়ে এসে রজনী বলল, আমাকে এ হোটেল বদল করতে হবে।
কেন?
স্বরাজ বিস্মিত হয়ে তাকাল তার দিকে।
কেন? কী হয়েছে?
স্বরাজ যে এতটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়বে তা ভাবেনি সে। তাকে যে সান্ত্বনা দেয়ার জন্যেই তখন হাসল রজনী। বলল, কিছু হয়নি তো। এমনি। এমনিতেই ভালো লাগছে না।
কেউ কিছু বলেছ?
স্বরাজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কারণ অনুসন্ধান করতে লাগল রজনীর মুখে। তার হঠাৎ মনে পড়ল পীরজাদার কথা। পীরজাদা তো কিছু অঘটন করে রাখেনি? স্বরাজের আরো সন্দেহ হলো এই ভেবে যে, পীরজাদাকে এ তিন সপ্তাহ ধরে খুব কম দেখা যাচ্ছে, ঘরে টেলিফোন করে জবাব পাওয়া যাচ্ছে না, তার সমুখে পড়লে এড়িয়ে যাচ্ছে, কিছু জিগ্যেস করলে আমতা আমতা করছে, এবং রজনীর কথা সে একবারও জানতে চাইছে না। যে রজনীকে পীরজাদা নিজে এনে দিয়েছিল তার কাছে, রজনীর প্রসঙ্গে সেই পীরজাদারই পাথরের মতো নীরবতা লালা স্বরাজকে ভাবিয়ে তুলেছিল। সরাসরি সে রজনীকে জিগ্যেস করে বসল, পীরজাদার সঙ্গে দেখা হয়েছিল?
রজনী আয়নার সমুখ থেকে প্রসাধন শেষ করে তার কাছে এসে বলল, না না, উনি কি বলবেন? ওঁর মত মানুষ হয় না। কেউ আমাকে কিছু বলে নি।
চিন্তিত হয়ে বসে রইলো লালা স্বরাজ। রজনীর জন্যে কী করা যেতে পারে ভাবতে ভাবতে কখন তার কপালে কুঞ্চন রেখা জেগে উঠেছে তা সে নিজেও জানে না। সেটা চোখে পড়ল রজনীর। সে বুঝলো তার চলে যাওয়ার কথা শুনে স্বরাজ হয়ত ভাবছে, এ তাকে এড়িয়ে যাওয়ার একটা ছল, সত্য কথার দ্ৰ পোশাক। তাই তাড়াতাড়ি ওর হাত থেকে সিগারেট নিয়ে অ্যাশট্রেতে নিবিয়ে দিল। লাইটারটা তুলে দিল। বলল, একটা কথা বললে এমন করে ভাবতে থাকেন, আমার আর কথা বলাই চলে না। আপনি বললে, এখানেই থাকব। ভাবছিলাম শুধু শুধু কত খরচ। সস্তা কোথাও হলে ঋণটা কমতো।
আজ সকালে রজনীর হোটেলের বিল সম্পূর্ণ শোধ করে দিয়েছিল সে। ইঙ্গিতটা তারই। লালা স্বরাজ উঠে দাঁড়িয়ে শুকনো গলায় বলল, তোমার মনটা আজ ভালো নেই রজনী। সঙ্গে সঙ্গে আমার মনও মেঘে ভরে গেল। ঋণের কথা তুললে কেন?
রজনী শুনে অপ্রতিভ হলো। ডাইনিং হলের জন্য বেরিয়ে এলো দুজন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে মনস্থির করল স্বরাজ। এই মেয়েটার কোথায় যে কী কষ্ট হচ্ছে তা বুঝতে পারছে না, কী করলে বোঝা যাবে তাও ঠাহর করতে পারছে না। সে বলল, রজনী, চলো আজ আমরা বাইরে যাই।
কেন, বাইরে কেন? সারাদিন তো বাইরেই কাটলো।
তাতে কী? জানো রজনী, করাচিতে রাতের একটা খুব সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ আছে, ভারী সুন্দর, এখন তোমাকে বলব না, চলো আজ দেখাবো। অনেকদিন আগে একদিন অধিক রাত্তিরে মোটরে করে আসতে আসতে আবিষ্কার করেছিলাম। কাজ করে ফিরছিলাম।
তার কথার ধ্বনিতে শিশুর মতো এক আগ্রহ রণিয়ে উঠলো। ছড়িয়ে পড়ল তা রজনীর মধ্যে। উজ্জ্বল চোখে সে বলল, কী সুন্দর হবে! না?
বীচ লাক্সারিতে বসে খেলো ওরা। দূরে সমুদ্রের গর্জন পৃথিবীর আলো কোলাহলের মধ্য দিয়ে অবিরাম পার হতে হতে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে এসে ভেঙে পড়ছে তাদের চারধারে। সমুদ্রের তীরে এখানে ওখানে গাছপালার ভেতর দিয়ে একটা দুটো করে বাতি জ্বলছে। নোনা হাওয়া দিচ্ছে মুখের পর।
হঠাৎ কাঁটা রেখে স্বরাজ শুধালো, তোমার গলার হার কই?
গলায় অজান্তে হাত ওঠালো রজনী। পরক্ষণে সে নামিয়ে নিল। মৃদু গলায় বলল, খুলে রেখেছি।
অলংকার তোমার ভালো লাগে না?
এইতো ভালো।
রজনীর লাজুক উত্তরটা মধুর লাগলো তার কাছে। চারদিকের জলুস ভরা মুখরা মেয়েদের পাশে রজনীকে অনেক রমণীয় অনেক দীপ্তিময় মনে হচ্ছে। স্বরাজ বলল, এইতো সত্যি ভালো। তুমি আমার ভেতরটাকে এমন করে বদলে দিচ্ছ রজনী, মনে হচ্ছে এতকাল যা জানতাম, বুঝতাম, সব মিথ্যে। আমি কিছু দেখিনি, বুঝিনি—- তোমার মধ্যে নতুন করে সব দেখলাম, বুঝলাম।
মনে মনে শিউরে উঠল রজনী। তার হারের ইতিহাস যদি কোন রকমে টের পায় স্বরাজ, প্রলয় কাণ্ড হয়ে যাবে।
সেখান থেকে বেরিয়ে ট্যাসি নিল ওরা। ড্রাইভারকে স্বরাজ বলল, গুরু মন্দিরের দিকে চলো।
পেছনের সিটে গা ঘেসে বসল দুজন। মুখের পর এই আলো এসে পড়ছে, ঐ পড়ছে না; একটা মোড়ে এসে অনেকক্ষণ দাঁড়াচ্ছে, তখন মাথার উপর বিজ্ঞাপন বাতি থেকে লাল–সবুজ আলো পালা করে রজনীকে ভিজিয়ে দিচ্ছে, দিচ্ছে না, দিচ্ছে—-যেন একটা বিরাট মঞ্চের পর নাটকের চরিত্রে সে; তিনটে মাকরানী জোয়ান হেঁটে যাচ্ছে অলস পায়ে, তাদের একজনের কাঁধে টিয়ে পাখি, পাখিটা চলার তালে তালে দুলে দুলে উঠছে, একটা বোরকা পরা মেয়ে রাস্তার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছে ভূতের মতো; আরেকটা মোড়ে আণ্ডারগ্রাউন্ড করিডরের মুখে রেলিং ঘেরা ফাঁকা স্কোয়ারে শুয়ে আছে ভিখিরি ভবঘুরে; দুটো লোক খাঁটিয়া টেনে এনে বসে অন্ধকারে ফুকছে সিগারেট; দাঁড়ানো খালি স্কুটারে উঠলো এক পাঠান, ড্রাইভার হাত বাড়িয়ে মিটারের ফালগ নামিয়ে দিল; তাদের ট্যাকসি মোড় নিল, মোড় নিতে গিয়ে আরেকটা পাখিকে চকিতে পাশ কাটাতেই রজনী টাল সামলাতে পারল না। স্বরাজের কাঁধের ওপর তার শরীর গিয়ে পড়ল। কোথা দিয়ে কী হলো বুঝতে পারল না রজনী। তার মনে হলো স্বরাজ তাকে দুহাতে ধরে ফেলল। স্বরাজের ইন্দ্রিয়ের মধ্যে ঝংকৃত হয়ে উঠল রজনীর গাত্র সুবাস।