কেন, লালা স্বরাজের কাছ থেকে।
হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে গেল রজনীর। হাতে চাবুক থাকলে পশুপেটা করত লোকটাকে। নেই বলে অসহায় দুহাত মুঠো হয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল তার। বেরিয়ে যাও, আমি চিৎকার করবো নইলে। পশু একটা পশু। তোমার কিছুতে বাধে না, কিছুতে আটকায় না।
থামলে কেন?
আর কিছু বলার প্রবৃত্তি আমার নেই।
আমার আছে।
কী বলবে?
দাঁড়াও।
মহসিন একটা সিগারেট বের করে ধরাল। প্রচুর একটা টান দিয়ে ওটাকে নিরীক্ষণ করল। তারপর বলল, জানতাম তুমি বুদ্ধিমতী মেয়ে। ঠিক ম্যানেজ করে নিতে পারবে। তাই ফেলে গিয়েছিলাম। একটা কথা কী জানো, মেয়েমানুষ হয়ে জন্মালে সুবিধে অনেক। শালার। একেক সময় ভাবি মেয়ে হয়ে জন্মালাম না কেন? লালা স্বরাজের মতো পাঁঠার কাছ থেকে একটা পয়সাও খসাতে পারোনি এটা কেমন কথা? বোকার মতো রাতে শুয়ে থাকলেই হলো? মালকড়ি বানাবার এইতো বয়স। কিছু পয়সা ছাড়ো। তারপর হাই তুলে বলল, দুদিন গোসল হয়নি। একটু হাত পা ছড়িয়ে গা ধুয়েনি। কী বল? শ খানেক হলেই আপাতত আমার চলে যাবে। বলে মহসিন বাথরুমের দিকে গেল। দরোজা খুলে কী ভেবে মুখ ফিরিয়ে বলল, পীরজাদার তো বেশ লোভ ছিল তোমার ওপর। তার নাকে দড়ি দিতে পারলে গ্র্যাণ্ড হতো। ব্যাটাছেলের প্রচুর টাকা। যা ওড়ায়।
দুম্ করে বন্ধ হয়ে গেলে বাথরুমের দরোজা। মিনিট খানেক পরে অঝোর ধারে পানি পড়া শব্দ।
রজনী একবার ভাবলো, নিচে গিয়ে ম্যানেজারকে ডেকে নিয়ে আসে। পরক্ষণেই মনে হলো, সে ভদ্রলোক মহসিনকে তার স্বামী বলে জানে, জানে সে ঢাকা গেছে। স্বামীর আবার অনধিকার প্রবেশ কী?
অবাক হলো এই ভেবে, কারো চোখে না পড়ে মহসিন হোটেলে তার কামরায় এসে ঢুকলো। কী করে? রজনী লালা স্বরাজের কথা চিন্তা করল। তাকে গিয়ে বললে কেমন হয়? মহসিনকে দেখে লালা স্বরাজ হয়ত বিনীতভাবে বিদায় নেবে। একদিনেই রজনীর জানা হয়ে গেছে, ভেতরে বাইরে স্বরাজ খাঁটি ভদ্রলোক; ঘরে চোরকে দেখে পেটানোর বদলে দরোজা খুলে দিয়ে বলবে, আপনি ভুল করে অন্য কামরায় ঢুকেছেন।
মহসিনকে দেখলেই লালা স্বরাজ নিশ্চিত ধরে নেবে, তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। মহসিন রজনীকে তার আগে ভালোবেসেছে, অতএব অগ্রাধিকার তারই।
মহসিনের মুখে পীরজাদার উল্লেখে লোকটার কথা বেশ কদিন পর মনে পড়ল। স্বরাজের সঙ্গ পেয়ে সে ভুলে গিয়েছিল এ লোকটার অস্তিত্ত্ব। এক কারণহীন অপরাধবোধে ভরে উঠল তার মন। মনে হলো, পীরজাদাকে সে প্রতারিত ও ক্ষুণ্ণ করেছে।
রজনী ঠায় বসে রইলো সোফার পরে। বাথরুম থেকে অবিরাম জলধারার শব্দ ভেসে আসছে। আজ সারাটা দুপুর তার কেটেছে লালুখেতে স্বরাজের এক বন্ধুর বাসায়। সেখানে তাদের দুজনের ছিল দুপুরের খাবার নেমন্তন্ন। সাজানো গোছানো দুটি মানুষের সেই সোনার সংসারে বিকেল অবধি কাটিয়ে রজনীর মন স্বপ্নে আচ্ছন্ন হয়ে ছিলো। তারও সংসার হবে, এমনি সংসার, আর লালা স্বরাজ। বলতে গেলে, লালা স্বরাজকে তার জীবন মৃত্যুর বন্ধু হিসেবে কল্পনায় আজ এই প্রথম স্পষ্ট করে সে এঁকেছে। সে ছবি এখন একটা উদ্যত কুৎসিত হাতে যে কোনো মুহূর্তে আর্তনাদ করে পড়বে মাটিতে।
মহসিন বেরিয়ে এলো। সে শুধু গোসলই করেনি, তার পরিত্যক্ত রেজার ব্লেড বের করে দাড়ি কামিয়েছে, একটু সুগন্ধও মেখেছে বুঝি, মৃদু বাস দিচ্ছে। তার দিকে তাকিয়ে নিজেকে বড় ক্লান্ত লাগল রজনীর। অসহায় চোখ মেলে তাকিয়ে রইল তার দিকে।
মহসিন তাকে চকিতে দেখে নিয়ে বলল, ভয় পাওয়া তোমার শোভা পায় না রজনী। তুমি অযথা ভয় পেয়েছ। তোমার সুখে বাদ সাধতে আসিনি। চলে গিয়েছিলাম পরোক্ষভাবে সেটা মঙ্গলের কারণ হয়েছে। তার জন্যে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করবে নিশ্চয়ই।
চুপ করো। চেঁচিয়ে উঠল রজনী।
মহসিন বলল, সবটা শোনো। অন্তত করাচি আসবার প্লেন ভাড়াটা আমাকে দাও।
করাচি আমি আসতে চাই নি।
হাসল মহসিন।
না এলে আমার কী সাধ্য ছিল জোর করে আনি। এতবড় মেয়েকে লজেন্স দেখিয়ে ভোলানো যায় না, হাত ব্যাগে পুরেও হাওয়া হওয়া যায় না।
তুমি যাবে?
টাকা দিলেই যাবো।
কিসের টাকা?
বাহ, তুমি থাকবে সুখে। আর আমি না খেয়ে রাস্তায় পড়ে মরবো?
তাই মরো।
কথাটায় মহসিন কানও দিল না। বলে চলল, ভালোই হয়েছে। কী বল?
কী ভালো হয়েছে?
এই তুমি যা করছ।
কী করছি আমি? কী করছি? বলো কী করছি?
চটে গেল মহসিন। মুখ বিকৃত করে বলল, ন্যাকা। কিছু বোঝো না? জিগ্যেস কর নিজেকে কী করছ। কাপড় খুলে দ্যাখো কী করছ। আরো বলতে হবে? দাও, টাকা দাও।
নেই।
নেই?
থাকলেও দেব না।
তাহলে আছে?
তোমার লজ্জা করে না?
লজ্জা তো তোমারও করতে পারত। সে যাক, লালা স্বরাজকে নাচাচ্ছ নাচাও। ও বোধহয় জানেও না। তোমার পেটে আমার ছেলে বড় হচ্ছে। জানে?
মুখ শাদা হয়ে গেল রজনীর। ঠোঁট কেঁপে উঠল মৃত্যুর মুখে প্রজাপতির মতো। কিন্তু কিছু বলবার মতো শক্তি পেল না। স্পষ্ট সে বুঝতে পারল, এ লোকটা তার সর্বনাশ করতে উদ্যত, যদি সর্বনাশের আরো কিছু বাকি থাকে। বোকার মতো যে প্রাসাদ সে কল্পনায় গড়ে তুলেছিল, এই একটা কথার উচ্চারণে তা ধূলোয় মিশে যাবে। ভয় হলো স্বরাজকে গিয়ে এখুনি হয়ত সে বলবে। স্বরাজের কাছে সে যে বলে বসে আছে, মহসিন তার স্বামী নয়, কেউ নয়। স্বরাজ যে জানেও না, রজনী মিথ্যে করে বলেছে মহসিন তার দেহস্পর্শ করেনি বলেছে, সে পবিত্র।