ফলটা হলো এই, তিনদিন যেতে না যেতে গুজব রটলো, লালা স্বরাজ এক বাঙালিনীর প্রেমে পড়েছে। গুজবটা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কানে পৌঁছুলো স্বরাজের। বন্ধুরা জ্বালিয়ে মারল টেলিফোনে। বান্ধবীরা মুখ গোল করে বিস্ময় প্রকাশ করল, অবশেষে বাঙালিকে? গুজবটা পল্লবিত হয়ে এ রকম আকার ধারণ করল—-লালা স্বরাজ গত এক বছর ধরে এ মহিলাকে ভালোবাসছিল, তার প্রমাণ—-গত এক বছর থেকে তাকে বাংলা শিখতে এবং বাংলা গান গুনগুন করতে শোনা গেছে। এতকাল চুপ করে থাকার ব্যাখা তারা করল স্বরাজ সাংবাদিক মানুষ, সংবাদ স্কুপ করে তাক লাগানো যার স্বভাব, তার পক্ষে এই–ই তো। স্বাভাবিক। মোটকথা, সত্য মিথ্যে যাই হোক, দ্রুত প্রচারিত এ গুজব তার কাছে নেহাৎ মন্দ লাগল না। চতুর্থ দিনে সে অ্যামপিজ–এর দোতলায় বসে খাখা দুপুরে কফি পান করতে করতে রজনীকে তার জীবন কাহিনী বলে ফেলল। সে ইতিহাস শুনে চোখ ছলছল করে উঠলো রজনীর। হয়ত তার নিজের বাবার কথা মনে পড়ে গেছে আচমকা। আঁচল তুলে চোখ মুছতে যাবে, লালা স্বরাজ তার হাত ধরে ফেলল, বলল, একী তুমি কাঁদছ?
মাথা নাড়তে গিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ল রজনীর। স্বরাজ তার শাদা রুমালে সে অশ্রু ধরে রেখে সযত্নে পকেটে পুরল। বলল, আমাকে করুণা না করে যে গৌরব তুমি দিয়ে গেলে তার যোগ্য নই। আমি হরিজনের ছেলে, আমার জন্যে অশ্রু হতে পারে স্বপ্নেও ভাবিনি।
রজনী তার উত্তরে বলল, এক সাধারণ মেয়ের অশ্রুকে এত বড় করে দেখলে অহঙ্কারের পাখায় ভর করে সে আকাশে উড়তে থাকবে। সেখান থেকে যদি কোনদিন তাকে মাটিতে নেমে আসতে হয় তো হতভাগিনীর আর দুঃখের অবধি থাকবে না।
এক মুহূর্ত চুপ করে রইলো লালা স্বরাজ। পরে বলল, সে দুঃখ কোনদিন আসবে না। তুমি আমাকে বিশ্বাস করতে পারো।
যেন সাপের মাথায় পা পড়েছে, সন্ধ্যের সময় বার থেকে ঘরে এসে শরীর শুদ্ধ চমকে উঠলো রজনীর। খাটের ওপর পা ঝুলিয়ে বসে মহসিন নিঃশব্দে হাসছে। অধঃপতিত একটা মানুষের অহংকার হলে যেমন হয়, হাসিটা তেমনি।
উনিশ দিন পরে এই লোকটাকে দেখে রজনীর কী রাগ হলো, না আনন্দ হলো, না বিস্ময়, না ভয়, তা এখনো বলা যাচ্ছে না। শুধু বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে রইলো সে।
মাথার চুল রুক্ষ, মুখ মলিন, চোখের কোলে কালিমা, এক গাল খোঁচা খোঁচা দাড়ি, গায়ের কাপড় ধোঁয়া পড়েনি কয়েকদিন। সব মিলিয়ে করুণার উদ্রেক হতে পারতো। কিন্তু সেটাও সম্ভব হলো না গা জ্বালানো ঐ নিচুস্তরের নিঃশব্দ হাসিটার জন্যে।
হাত তুলে রজনী বলল, বেরিয়ে যাও।
নিজের কথা নিজের কানে পৌঁছুতেই চমকে উঠলো রজনী। আজ মহসিনকে একথা বলতে হচ্ছে, এর চেয়ে অবিশ্বাস্য অপ্রত্যাশিত যেন আর কিছু হতে পারে না। এক পলকের জন্যে অনুতাপও হলো। হাতটা নামিয়ে আনলো সে আস্তে আস্তে। অবসন্ন কণ্ঠে উচ্চারণ করল, যাও।
মহসিন মুখ থেকে হাসি সরালো। আপাদমস্তক রজনীকে দেখল অনেকক্ষণ সময় নিয়ে। তারপর উঠে এসে তার সম্মুখে একেবারে মুখের কাছে মুখ স্থাপিত করে, শরীর দিয়ে শরীরকে প্রায় ছুঁয়ে দাঁড়াল। ভয়ে চোখ বুজলো রজনী। ভয় করছে কেন? টের পেল, মহসিন আবার ফিরে গেল। চোখ মেলে দেখল, ফিরে গিয়ে লোকটা চেয়ারের পরে অধোবদনে বসে আছে।
এ উনিশ দিন কোথায় ছিল মহসিন, কিভাবে ছিল, খুব একটা ভালো ছিল না, এসব কথা মনে করে মন খারাপ করল তখন। কিন্তু অবাক হয়ে রজনী তার মনের দিকে তাকিয়ে দেখল, মহসিনের জন্যে ভালোবাসার এতটুকু আর অবশিষ্ট নেই এ হৃদয়ে। যে লোকটার কথায় একদিন অন্ধের মতো সে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়েছিল, যে লোকটার মধ্যে তার আশ্রয়, ভবিষ্যত, সুখ, সম্পদ সমস্ত কিছু দেখেছিল সেই একই লোক এই উনিশ দিনে তার জীবনে তুচ্ছের চেয়েও মূল্যহীন হয়ে গেছে। তাকে ফেলে চলে গেছে বলে রাগ হচ্ছে না, দুঃখ হচ্ছে না, কেনই বা হবে? রজনী নিজেও যেটা বুঝতে পারছে না তা হচ্ছে, লালা স্বরাজের অন্তরংগ আন্তরিকতা তাকে এমন করে ঘিরে ফেলেছে যে মহসিন কোনো অস্ত্র দিয়েও সে ব্যুহ ভেদ করতে পারবে না।
বরং মহসিনকে দেখে রজনীর অন্তর চমকে উঠেছিল। তার সুখের দিন বুঝি ফুরালো। লালা স্বরাজ যে পৃথিবীর সন্ধান তাকে দিয়েছে, এত গভীরভাবে সে সেটাকে বিশ্বাস করেছে, যে মহসিনের হঠাৎ আবির্ভাবে অমঙ্গলের সম্ভাবনায় রজনী এখন বিচলিত।
মহসিন হঠাৎ মাথা তুলে বলল, রজনী, আমাকে কিছু টাকা দাও।
কথাটা এত অপ্রত্যাশিত যে রজনীর মনে হলো সে ভুল শুনেছে। সে জিগ্যেস করল, কী? টাকা। নেই?
রজনী বিস্মিত হলো। বুঝতে পারল না তার কাছে মহসিন টাকা চাইছে কেন? মহসিন তো ভালো করেই জানে, তার হাতে একটা পয়সাও নেই। যে গোটা তিরিশেক টাকা ছিল সেটা অনেক বুদ্ধি করে আদায় করা। মহসিন তার ঢাকা থেকে আনা টাকা নিজের কাছেই রেখেছে, নিজে খরচ করেছে। সে টাকা এ দেড় মাস ধরে খরচ হয়েছে। টাকা সম্পূর্ণ খরচ হয়ে গেছে, অথচ কাজের কোন আশা না দেখেই যে সে একদিন পালিয়ে গেছে এ কথাটাও ওর চলে যাবার পরদিনেই বুঝতে পেরেছিল রজনী। বরং সে তার পরম সম্পদ, তার লজ্জা, রাতের পর রাত হরণ করে পালিয়েছে। একটিবার ভাবেনি তার কী হবে। সে কথা মনে করে ভীষণ আক্রোশ হলো রজনীর। সে যদি গলায় দড়ি দিত, তার মৃত্যুর জন্যে দায়ী হতো মহসিন। এত বড় সর্বনাশ করবার পরও লোকটা আবার এসেছে তার কাছে, টাকা চাইছে, শুনে গা জ্বলতে লাগল রজনীর। মহসিন যে স্পষ্টই অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে, পশুর মতো কোথাও পড়ে রাত পার করছে—- এটা তার চেহারায় লেখা দেখা যাচ্ছে। তবু রজনীর দয়া হলো না এতটুকু। সে বলল, আমি কোথায় টাকা পাবো?