রজনী একদিকে অবাক হয়ে গিয়েছিল লালা স্বরাজের বিদেশী জিহ্বা থেকে বাংলা কবিতা শুনে, অন্যদিকে তার মনে হচ্ছিল, এ কবিতার অর্থ কী আর ইঙ্গিতই বা কী লোকটা তা ভালো করে জানে না। যদি জানতো তাহলে অমন নিঃসকোচে আবৃত্তি করে শোনাতে পারত না তাকে। যত স্বচ্ছন্দ পুরুষই হোক না কেন, পয়ারের চোদ্দ লাইন বলে যেতে যে সময় লাগে ততক্ষণ ধরে প্রেমের অমন আকুতি জানানো যায় না। রজনীর কল্পনাক্ষমতা অসীম। সে যেন এতকাল মনে মনে এই নিবেদনেরই ধ্বনি শুনতে চেয়েছিল। লালা স্বরাজের সোনার মতো ভাগ্য। সে নিজের অজান্তে রজনীকে তৃপ্ত করলো। ফলে আবৃত্তি শেষে যখন সে শুধালো, আমার উচ্চারণ কেমন? তখন রজনী আকাশ থেকে পড়ল। স্বপ্নভঙ্গের দুঃখে খানিকক্ষণ চুপ করে রইলো সে। লালা স্বরাজ সে চুপ করে থাকার ব্যাখা করল, পরীক্ষায় তার ডাহা ফেল হয়েছে। বলল, আবৃত্তি শুনে হেসে ফেলেননি, কঠিন মনোবল আপনার। আজ থেকে আমি আপনার ছাত্র। এ কবিতার কোথায় ত্রুটি হলো মনে রাখবেন, শুধরে দিতে হবে।
রজনী হেসে বলল, আচ্ছা। এবারে উঠুন।
ভাগ্যকে চিনতে শিখেছে রজনী। এটুকু তার উপলব্ধি হয়েছে, পরম বন্ধুও বন্ধু নয়। মাত্র সাতদিনের ব্যবধানে রজনী এখন এত পরিবর্তিত যে তাকে দেখে আর চেনা যাবে না।
অবশ্যি মাথার ওপর দিয়ে ঝড় গেছে। যে গাছটা এতকাল ফুলে ফলে পল্লবিত সবুজ, কালবোশেখীর পর তার পত্রহীন রূপ দেখে অবাক হতে হয়। রজনীর এখন সেই দশা। বেঁচে থাকার দুরন্ত তাগিদে রাতারাতি যেন নতুন পাতার কিশলয় দেখা যাচ্ছে।
হোটেল কোলামবাসের ম্যানেজারকে বুদ্ধি করে লালা স্বরাজ নিজেই জানিয়ে দিয়েছিল, মহসিনকে জরুরি কাজে ঢাকা যেতে হয়েছে। রজনী কিছুকাল থাকবে। ম্যানেজারের কাছ থেকে জানা গিয়েছিল প্রায় সাতশ টাকা বাকি। লালা স্বরাজ মনে মনে হিসেব করেছিল, রজনীর ঢাকা ফিরে যেতে লাগবে আরো দুশ কিছু। অর্থাৎ এক হাজার টাকার ধাক্কা।
কথাটা রজনীকে জানাতেই তার মুখ শাদা হয়ে গেল। তার ধারণা ছিল, এবং স্বরাজকেও বলেছিল, গায়ের গহনা বিক্রি করে সব খরচা মোকাবেলা করা যাবে। হাতে তার খুব বেশি হলে ছিল গোটা তিরিশেক খুচরো টাকা। নিজের প্রচুর খাদ মেশানো হার আর কগাছা চুড়ি আংটির বদলে বড়জোর তিনশ টাকা আসতে পারে। বাকি টাকা পাবে কোথায়?
তার ভয়ার্ত মুখ লক্ষ্য করে লালা স্বরাজ ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল। পরামর্শ দিয়েছিল বাড়িতে চিঠি লিখতে। তারা নিশ্চয়ই একটা ব্যবস্থা করতে পারবে। কিন্তু রজনী সেদিন মুখ ফুটে বলতে পারেনি, বাড়িতে চিঠি সে কোনদিনও লিখতে পারবে না। তার চেয়ে গলায় দড়ি দেয়া বরং অনেক সহজ ও সুলভ। প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্যে উত্তর করেছিল, হ্যাঁ, সে বাড়িতেই চিঠি লিখবে।
তারপর দুদিন লালা স্বরাজ জিগ্যেস করেছে, বাড়িতে সে চিঠি লিখেছে কিনা? রজনী উত্তর করেছে, হ্যাঁ লিখেছে।
এত সহজে, মুখে কোন চিহ্ন না ফুটিয়ে, মিথ্যে বলার ক্ষমতাটা রজনীর একেবারেই নতুন পাওয়া। ঢাকা সে কোনকালেও ফিরে যেতে পারবে না। ফিরে গেলেও বাড়িতে তার স্থান হবে কিনা সে সম্পর্কে প্রচুর সন্দেহ আছে। স্থান হলেও কপালে যা জুটবে তা মনে করেও শিউরে উঠতে হয়। এদিকে, করাচিতে এমন করেই বা থাকা চলে কদ্দিন? একটা করে মুহর্ত যায় আর রজনীর মনে হয় জীবন থেকে একটা নিরাপদ মুহূর্ত ব্যয়িত হয়ে গেল। করাচিতেই কি তার মৃত্যু হবে? মহসিন চলে যাবার দ্বিতীয় রাতে সে স্থির করল, না, ঢাকাতেই ফিরে যাবে রজনী। তবু বাংলাদেশ। বাবা মায়ের দেশ। নাইবা উঠল সে বাবার কাছে। এই একটা দিনে তার এতটুকু জ্ঞান হয়েছে যে, নারীর একেবারে নিজস্ব অস্ত্রগুলো দিয়ে বিপদের অনেক ব্যুহ ভেদ করাই সম্ভব। ঢাকায় ফিরে গিয়ে নিজের একটা আশ্রয় খুঁজে পাওয়া হয়ত একেবারে কঠিন হবে না। জীবনে তার বড় কিছু চাইবার নেই—- নিরাভরণ সামান্য হলেই তার স্বর্গ।
কিন্তু আদৌ সে যেতে পারছে কী করে? এই নির্বান্ধব শহরে এক হাজার টাকা তাকে কে দেবে? মনে করে দিশে পেত না রজনী। তখন মন থেকে জোর করে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইলে দুশ্চিন্তা।
তখন লালা স্বরাজের সান্নিধ্য ভালো লাগত। লালা স্বরাজের ঐ একটা গুণ, তার সঙ্গ পেয়ে সব কিছু ভুলে থাকা যায়। অনেকক্ষণ ধরে এই বিভ্রান্তিটা থাকে যে, তার কিছুই হয়নি। তার সব আছে। তার সংসারে আনন্দের প্রস্রবণ বইছে। এবং এই যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্বরাজের সঙ্গে শহরের এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত অবধি ঘুরে বেড়ানো চলছে, কখনো বসছে ক্লিফটনের সেই রেস্তোরাঁর দোতলায়, কখনো এলফিনস্টোনের আলোক মুখরিত বিপণির দরোজায় দাঁড়িয়ে জিনিস এবং মানুষের সমারোহ দেখা হচ্ছে, সেজানের রাত্রিতে টেবিলের দুই প্রান্তে বসে বেহালায় হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে উৎসারিত কান্নার মতো সুর শুনতে শুনতে খাওয়া পড়ে থাকছে, লালা স্বরাজের মুখে স্পন্দিত আবৃত্তি শুনে তার আজীবন স্বপ্নের প্রতিবাস সৃষ্টি হচ্ছে—-এ সব মিলিতভাবে তার আড়াল, তার সংকোচ, তার আশংকা সমস্ত কিছুকে কখন তুচ্ছ করে দিয়েছে তা রজনীও ভালো করে বলতে পারবে না।
অন্য দিকে লালা স্বরাজ তার বাংলা প্রীতির তোড়ের মুখে এরকম নিখাদ একটি বাঙ্গালি মেয়ের সঙ্গ পেয়ে উদ্দাম হয়ে উঠেছে। রজনীকে নিয়ে সে এরই মধ্যে তার বন্ধুদের বাড়িতে গিয়ে আচমকা হানা দিয়েছে অবাক করে দেবার জন্যে। পার্টিতে, সিনেমায়, ফেলর শো–তে নিয়ে গেছে রজনীকে জাহির করবার জন্যে। মধ্যযুগের উদ্ধত কিন্তু নারীর কাছে বিনীত সেনানায়কের মতো সে রজনীর ক্ষীণ কটি আভাসে একহাতে বেষ্টন করে বিজয়গর্বে বিচরণ করেছে এ শহরের অভিজাত আড্ডায়।