সে ছিল অভিজ্ঞ বেয়ারা। তার নিজের পছন্দের ওপর ছেড়ে দেয়াতে লোকটা গর্বিত হলো, এবং এমন এক স্মিত হাস্যের সঙ্গে প্রস্থান করল যার অর্থ কোনটা সেরা তা আমি জানি, আর আমি যে জানি তা আপনিও স্বীকার করবেন একটু পরেই।
ঠিক তখন আলো স্তিমিত হলো। এক মুহূর্তের ব্যবধানে রণিয়ে উঠলো সঙ্গীত। মৃদু বিচ্ছুরিত নীল আলোচক্রের মধ্যে এসে অভিবাদন জানালো স্বল্পবাস পরিহিতা প্রায় নগ্ন রাজিয়া। তার চোখে নীল সুরমা, মৎসপুচ্ছের অনুকরণে অঙ্কিত তার আঁখিকোণ। রক্তিম বুকের ঊর্ধ্ব থেকে উন্মুক্ত নাভিমূল অবধি এক সূক্ষ্ম সুরমা রেখার কারুকাজ। পীরজাদা তার বিক্ষিপ্ত মন। কেন্দ্রীভূত করবার চেষ্টা করল। ঐ বিদ্যুতের মত সঞ্চরণশীল শরীরে তার একাগ্র দৃষ্টি স্বর্ণ সন্ধানীর মতো ভ্রমণ করতে লাগল।
খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেছে বেয়ারা। সে খেতে শুরু করল। সেখানেও চেষ্টা করল একাগ্র হতে, খাদ্যের স্বাদ পূর্ণ উপলব্ধি করতে।
স্রোতোধারার মতো হিল্লোলিত হচ্ছে, রাজিয়ার মর্মর শুভ্র কাঁধ। কাঁধ থেকে স্পন্দিত তরঙ্গ নেবে আসছে মরুভূমির জ্যোছনা মাখা বিশাল বালুবীথির মতো দুই স্তনে, সেখানেও স্থির থাকছে না তরঙ্গ, গিয়ে পৌঁছুচ্ছে চিতাবাঘের বুকের মতো দুই ঊষর উরুতে। সেখানে মূর্হিত হচ্ছে এবং পর মুহূর্তে আবার কাঁধ থেকে তার পুনরাবৃত্তি চলছে। চক্রাকারে ঘুরে উঠছে নাভি, যেন তার মধ্য থেকে এখুনি উৎক্ষিপ্ত হবে কামনার ফুল। পরক্ষণে তা স্তম্ভিত হচ্ছে। তখন পদ্মদলের মতো সঙ্গীতের ওপর ভাসছে রাজিয়া। সে লুটিয়ে পড়ছে, তার দুই বাহু শৃঙ্খলিত বন্ধনের ভঙ্গিতে বিলাপ করছে দয়িতের স্পর্শ কামনা করে।
কিন্তু তবু রজনীকে ভোলা যাচ্ছে না। এক মুহূর্তের জন্যে যেন ঘোর লেগেছিল। সেটা স্থায়ী হতে পারল না। খাদ্য বিস্বাদ ঠেকল।
রাজিয়া তার পায়ের কাছে এসে লুটিয়ে পড়েছে। মেঝেয় গড়াচ্ছে তার সুতনু। ঝড়ে উৎক্ষিপ্ত গোলাপ পথিকের পায়ে পিষ্ট হতে চায় যেন এই তার সুখের মরণ। একেবারে নিকট থেকে নারী দেহের অনাবৃত জীবন্ত মসৃণতা তার চোখ আচ্ছন্ন করে ফেলল। চোখের সমুখে যেন কোটি কোটি রক্তমুখ রোমকূপ ছাড়া আর কিছুই সে দেখতে পেল না। হাত বাড়াতে গেল পীরজাদা। ঠিক তখন তীরের মতো উৎক্ষিপ্ত হলো রাজিয়ার দেহ। চোখের পলকে অপসৃত হলো দূরতম কোণে।
পীরজাদা উঠে দাঁড়াল। না, এসবে কিছু হবে না। বমি করতে ইচ্ছে করছে তার। গাড়িতে এসে বসলো। এর চেয়ে হোটেলে ফিরে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে কেমন হয়?
অন্ধকারে স্ফটিক প্রাসাদের মতো দাঁড়িয়ে আছে হোটেল কোলামবাস। শহরের এ দিকটা এমনিতেই নির্জন, বাত বারোটা বাজেনি, এরি মধ্যে চলে গেছে সবাই। করিডর, হল, সিঁড়ি, ফুলের টব হঠাৎ বড় হয়ে গেছে যেন।
পীরজাদা অবাক হয়ে ভাবল, মানুষের উপস্থিতি কী দাম্ভিক, সমস্ত কিছুকে তার সমুখে। সংকুচিত হয়ে থাকতে হয়ে।
শূন্য করিডর দিয়ে যেতে যেতে ডাইনিং হলের পাশে থমকে দাঁড়াল পীরজাদা। নিস্তব্ধ বিশাল হলের শেষ প্রান্তে দুটি মানুষ তখনো বসে আছে। সারা ঘরে আর কেউ নেই। দূর থেকে এতটুকু দেখাচ্ছে তাদের, যেন স্বপ্নের মধ্যে একটা ছবি।
ওরা রজনী, রজনী আর লালা স্বরাজ। রজনী বসে আছে তার দুকনুই টেবিলে তুলে যুক্ত করতলের কাপে চিবুক রেখে। অপরূপ তার সজ্জা। তাতে উগ্রতা নেই, স্নিগ্ধতা আছে। ঐশ্বর্য নেই, দীপ্তি আছে। দুপুরে দেখা রজনীর সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। যেন মলিন ফুলদানি মার্জিত হয়ে ঝকঝক করছে।
বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো পীরজাদা। লালা স্বরাজের ধীর ফিসফিস কণ্ঠ ভেসে আসছে। কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তার প্রতিক্রিয়া রজনীর চোখে মুখে ফুটে উঠছে। আগ্রহ এবং লজ্জার এক অপরূপ সমন্বয় রজনীর মধ্যে প্রত্যক্ষ করল সে।
লালা স্বরাজের সান্নিধ্যে, মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে কী করে এমন পরিবর্তন ঘটলো রজনীর তা মাথায় ঢুকলো না পীরজাদার। নিজের ঘরে এসে দেখল স্বরাজের চিরকুট পড়ে আছে। তার লেখা মাথার মধ্যে আগুন ছড়ালো। কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলে দিল চিরকুটখানা। রজনীর স্বামীকে খুঁজে বার করবার কোনো দায় নেই তার। ঈর্ষার ভীষণ আগুনে দন্ধে মরতে লাগল সে।
পীরজাদার ভাগ্য বলতে হবে। কারণ ডাইনিং হলে তখন লালা স্বরাজ রজনীকে যা বলেছিল সেটি একটি কবিতা রবীন্দ্রনাথের কবিতা। লালা স্বরাজ তার বাংলা সাহিত্যজ্ঞানের মুখস্ত পরিচয় দিচ্ছিল রজনীকে। তার এক বর্ণ বুঝলেও পীরজাদার ঈর্ষার মাত্রা সহস্রগুণে বাড়তো। সন্দেহ নেই। তবে তাতে করে রজনীর মুখে লজ্জা এবং আগ্রহের মিশ্রিত প্রকাশটি কেন, তা বোঝা যেত। লালা স্বরাজ আবৃত্তি করছিল।
তোমার স্বপ্নের দ্বারে আমি আছি বসে
তোমার সুপ্তির প্রান্তে, নিভৃত প্রদোষে
প্রথম প্রভাত তারা যবে বাতায়নে
দেখা দিল। চেয়ে আমি থাকি একমনে
তোমার মুখের পরে। স্তম্ভিত সমীরে
রাত্রির প্রহর শেষে সমুদ্রের তীরে
সন্ন্যাসী যেমন থাকে ধ্যানাবিষ্ট চোখে
চেয়ে পূর্বতট পানে, প্রথম আলোকে
স্পর্শ মান হবে তার এই আশা ধরি
অনিদ্র আনন্দে কাটে দীর্ঘ বিভাবরী
তব নবজাগরণী প্রথম যে হাসি
কনক চাঁপার মতো উঠিবে বিকাশি
আধো খোলা অধরেতে, নয়নের কোণে
চয়ন করিব তাই, এই আছে মনে।