ত্রিনিদাদে যেদিন পা দিয়েছিল সেদিনই সে নিজেকে অনাথ বলে পরিচয় দেয়। লালা বিক্রমদেব তাকে অনাথ জেনেই দত্তক নিয়েছিল। অথচ স্বরাজ জানতো তার বাবা দশরথ আজো বেঁচে আছেন। বাবার জন্যে থেকে থেকে মনের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠত, লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদত কিশোর স্বরাজ। কিন্তু কাউকে বলতে পারেনি। এটুকু জ্ঞান তার সেই বয়সেই হয়ে গিয়েছিল যে, পিতৃপরিচয় দিলে তাকে লালা বিক্রমদেবের আশ্রয় থেকে বেরিয়ে পথে। না খেয়ে মরতে হবে। সেটা দুকারণে। প্রথমত তার পিতা জীবিত। দ্বিতীয়ত, সে হরিজনের সন্তান। লালা বিক্রমদেব নিজে খ্রিষ্টান হলেও হরিজন থেকে যে ছেলে খ্রিষ্টান হয়েছে তাকে। পুত্র হিসেবে কেন, চাকর হিসেবেও বাড়িতে রাখবেন না।
সাংবাদিকতায় পাশ করে লালা স্বরাজ আর ত্রিনিদাদে ফিরল না। দীর্ঘ কুড়ি বছর পর ফিরে এলো করাচিতে। কাজ নিল এ শহরেই। আর খুঁজল তার বাবা দশরথকে। গিয়ে দেখল, সে। বস্তি কবে উঠে গেছে। কেউ বলতে পারল না দশরথের কথা।
সম্ভাব্য অসম্ভাব্য সমস্ত জায়গায় ঘুরেছে, করাচির একটা গলি খুঁজতে বাদ রাখেনি, কিন্তু সন্ধান পাওয়া যায়নি দশরথের। সমাজের যে স্তরে সে আছে, সেখান থেকে কুলি ধাঙড় ঝাড়ুদারের সমাজ অনেক দূরে। এ দূরত্ব হলো তার অনুসন্ধানের আরেক বাধা। মুখ ফুটে সে বলতে পারল না, আমি আমার বাবা দশরথকে খুঁজছি। দশরথের নাম চিহ্ন পরিচয় যেন এ পৃথিবী থেকে চিরদিনের মতো মুছে গেছে।
আজো সে কোন ধাঙড় ঝাড়ুদার দেখলে দাঁড়ায়। চোরের মতো চারদিক দেখে হাতে পয়সা গুঁজে দিয়ে জিগ্যেস করে দশরথ বলে কোনো বুড়োকে তারা চেনে কিনা। ঠিকানা দেয় নিজের। বলে দেয়, খোঁজ দিতে পারলে পাঁচ শ টাকা দেবে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে কেউ আর আসে না। আজ পাঁচ বছর হয়ে গেছে কেউ আসেনি।
তন্ময় হয়ে ভাবছিল লালা স্বরাজ। পেছনে একটা মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে সচকিত হয়ে ঘুরে দাঁড়াল। দেখল, রজনী। চাপা রংয়ের শাড়ি পরে, সজ্জা করে, চুলের বেণি বুকের পরে দুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নত চোখে। মধুর হেসে স্বরাজকে আপ্যায়ন করল সে। স্বরাজ বলল, অনেকক্ষণ লাগলো।
কই না তো।
শাড়ির আঁচল দিয়ে সারা শরীর ঢেকে কুণ্ঠার সঙ্গে উত্তর করল রজনী। কাজটা দেখে স্বরাজ শুধালো, আপনার কি খুব ঠাণ্ডা লাগছে?
কেন, না।
অমন জড়সড় হয়ে আছেন, তাই বললাম।
না, একটুও না।
বেশতো। তাহলে ভালো করে গুছিয়ে নিন আঁচলটা। বাঙালি মেয়ের শাড়ি পরা সারা বিশ্বের মেয়েরা লুফে নিচ্ছে, আর তার নমুনা এই!
রজনী অবাক হলো। তার সজ্জাই বা কী? যতটুকু আছে তা–ই যে একটা মানুষের মনোযোগ কেড়ে নেবে এটা তাকে সলজ্জ করল। মনটা উসখুস করে উঠল, যেন ভারী অপরাধ করে ফেলেছে সে। মৃদুকণ্ঠে বলল, কেন, এইতো ঠিক আছে।
উঁহু, ঠিক নেই। আঁচলটা অমন করে থাকবে কেন? বড় আনস্মার্ট লাগবে যে। শাড়ি অমন করে পরে নাকি কেউ? বাইরে দেখলে হাসবে।
কারা?
যারা হাসে। পোশাক তো সবাই পরে, তাই বলে সেটা সুন্দর করে পরতে হবে না?
আচ্ছা।
রজনী ভেতরে গিয়ে ঢং বদল করে এলো। এবারে সে আঁট করে পরেছে। হালকা লাগছে শরীর। আর বদলেছে গায়ের জামা। কেমন লজ্জা করছে তার। লালা স্বরাজ দেখে বলল, চমৎকার। এতক্ষণে মনে হচ্ছে, আপনার সব দুশ্চিন্তা গেছে। আগে মনে হচ্ছিল স্নান, প্রাণহীন। চলুন।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে লালা স্বরাজ তাকে হাত বাড়িয়ে সাহায্য করল। সংকোচ করতে গিয়ে তা জয় করল রজনী। লোকটার সবকিছুর মধ্যে এমন এক আন্তরিকতা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে যা বিশ্বাস করতে মন সায় দিচ্ছে। তার মুঠোর মধ্যে রজনীর হাত এতটুকু কাঁপল না।
৪. মনের মধ্যে প্রলয়কাণ্ড
মনের মধ্যে প্রলয়কাণ্ড চলছিল পীরজাদার। একবার মনে হচ্ছে, রজনীকে সাহায্য করা উচিত ছিল তার; আবার ভাবছে, নিজেকে রজনীর কাছ থেকে শত হস্ত দূরে রাখার সিদ্ধান্তই সঙ্গত। আসলে, রজনীর প্রতি তার হৃদয় যে ভীষণ রকমে আকৃষ্ট, এ সত্য থেকে মুক্তি পাবার জন্যেই এ মানসিক দ্বন্দ্বের অবতারণা।
মানব চরিত্র খুব কম বোঝে সে, নিজেকে তো আরো নয়। পীরজাদা সে অভাব চিরকাল এক অবোধ দুরন্ত অভিমান দিয়ে ভরিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে।
রজনীকে লালা স্বরাজের হাতে তুলে দিয়ে তক্ষুনি বেরিয়ে পড়া—- এটাও সেই অভিমানেরই কীর্তি। কিন্তু বাইরে এসেও মুক্তি পাওয়া গেল না। মন বসলো না কোথাও। রজনী, মাথার মধ্যে রজনীর মুখ সম্রাজ্ঞীর মতো আঁকিয়ে বসে আছে। এ যন্ত্রণা সুরাপানে মিটল না। এসেলশিয়রে বসে বসে সে পন্থায় ব্যর্থ হলো সে, তখন এলো মেট্রোপলে। কায়রোর মোহিনী নর্তকী রাজিয়া শহরে এসেছে। তার নন্দিত যৌবনের ছবি আজকের কাগজে দেখেছিল পীরজাদা। আজ মেট্রোপলে তার নাচের প্রথম রাত।
স্ত্রীর বীভৎস মৃত্যুর পর এক রজনী ছাড়া অন্য কাউকে দেখে বিচলিত হয়নি পীরজাদা। এটা অন্যায় মনে হয়েছে তার কাছে। এবং তাই এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে, নর্তকী রাজিয়ার দেহ। প্রদর্শনী দেখে যদি এতটুকু চঞ্চল হয় তার স্নায়ু, তাহলে পাপবোধের বোঝাটা খানিক হাল্কা হবে। এ যেন নিজেকে শাস্তি দেয়া; রজনী ছাড়া অন্য কাউকে ভালো লাগবে না কেন—-মনকে এ রকম একটা ধমকানি দেয়া।
বেয়ারা এসে সালাম করল। ডিনারের অর্ডার দিল পীরজাদা। ডিনারে কী পছন্দ করবে সে? তার জবাবে বলল, তোমার রাধুনির আজ যা সেরা, তার সমারোহ দেখতে চাই আমার টেবিলে।