নিশ্চয়ই আছে। শহরে বেড়াতে হলে এই তো সময়। প্রকৃতিকে দেখতে হলে দিন, আর শহর—- রাতে। চলুন, আপনার কিছুতেই মন খারাপ করে বসে থাকা চলবে না। আমি বাইরে দাঁড়াচ্ছি। আপনি কাপড় বদলে নিন।
লালা স্বরাজ বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বেশ সুন্দর একটা বাতাস দিচ্ছে। চাঁদ উঠেছে। কেবল উঠেছে। কেবল উঠেছে বলে অনেক বড় আর লাল দেখাচ্ছে চাঁদটাকে; মনে হচ্ছে জন্মের কষ্ট হচ্ছে চাঁদটার। মাঝরাতে যখন আকাশের মাঝখানে এসে পড়বে, তখন ঝকঝক করতে থাকবে, আনন্দের মতো দেখাবে।
একটা চিরকুট লিখল স্বরাজ। লিখল—-আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। তুমিও দ্যাখো। তুমিও খোঁজ করো। কেবল আমার ভরসায় থেকো না।
লিখে কাগজটা পীরজাদার দরোজার ভেতরে চালিয়ে দিল। তারপর একটা সিগারেট ধরিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইল সে।
নিচে লনে চেয়ার পেতে কেউ কেউ বসেছে। মনে হচ্ছে, অন্ধকারের মধ্যে শাদা শাদা শরীরগুলো কে যেন এঁটে রেখে গেছে চাবি দিয়ে।
একটা গাড়ি এসে থামল, কেউ নামলো, গাড়িটা গড়িয়ে অন্ধকারের মধ্যে গিয়ে বসে রইল হামা দিয়ে।
মানুষ যদি বেঁচে থাকে তো একদিন না একদিন তাকে খুঁজে পাওয়া যাবেই। লালা স্বরাজ অবাক হয়ে ভাবল, যে কথাটা সে অবিশ্বাস করতে শুরু করেছে বহুদিন আগে থেকেই, আজ সেটাই কী করে সে এত বিশ্বাস নিয়ে উচ্চারণ করতে পারল?
সেই যে সমাজের অস্পৃশ্য হরিজন বলে বাবা বেরুতে দিতেন না, তাতে কী? স্বরাজ ছুটিবারে যেত সায়েবদের বাংলার পেছনে মালি খানসামাদের কোয়ার্টারে। সেখান থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখত একটা নতুন জগৎ। স্বর্গের মতো। ফুলের মতো ছেলেমেয়েরা, তারই বয়সী, খেলছে, লাফাচ্ছে, দৌড়াদৌড়ি করছে। মা তাদের লাল চুলে বো বেঁধে দিচ্ছেন ছেলেটাকে ডেকে গানের মতো গলায় কথা বলছেন। চটপট মাকে কী যেন বলছে সে ছেলে। হাসছে। তার পোকায় খাওয়া দাঁত খুশিতে কী সুন্দর দেখাচ্ছে। খুব ঝিলিক দিয়ে রোদ উঠেছে। মাঠ খুব সবুজ হয়েছে। শাদা হাফ প্যান্ট পরে সায়েব বাগানে ঘুরছেন। বক্লস বাধা কুকুরটা তার পেছনে পেছনে যাচ্ছে।
এক আধদিন সায়েবের মুখোমুখি পড়ে গেলে চোরের মতো পালাতে চেষ্টা করত স্বরাজ। কিন্তু পরক্ষণেই দেখত, না, তাকে তাড়া করছেন না উনি। বরং কাছে ডেকে প্রথম দিনই নাম পরিচয় জিগ্যেস করেছিলেন; এবং দ্বিতীয় দিনে কুকুরটা একটা বেড়াল দেখে খুব লাফাচ্ছিল, বেড়ালটাকে ধরে বেঁধে দূরে কোথাও ফেলে দিতে বলেছিলেন সায়েব। এ বেড়ালটা জ্বালাত রোজ। একটা কাজ পেয়ে স্বরাজ সেদিন মহাখুশি। তাকে কায়দা করে মাখা রুটির লোভ দেখিয়ে, ধরে, বস্তাবন্দি করে পিঠে ঝুলিয়ে স্বরাজ একটা চলন্ত ট্রাকের ওপর তুলে দিয়েছিল।
এমনি করে চেনা হয়ে উঠেছিল স্বরাজ সেই সায়েব পরিবারে।
এখন ছুটিবারে তার কাজ সায়েবের ছোট দুই ছেলে আর মেয়েটার সঙ্গে খেলার যোগান দেয়া। পাখির ছানা পেড়ে আনা, লুকিয়ে দুপয়সার তেলেভাজা এনে খাওয়ানো, চাচার নতুন মাদল চুরি করে ওদের উপহার দেয়া এই চলছিল। একদিন মেয়েটা, পাঁচ বছরও হবে না, স্বরাজকে ডেকে নিয়ে খেলার ছোট অর্গান দেখাচ্ছিল, উপুড় হয়ে বসে রীডে টুং টুং আওয়াজ করছিল। অতটুকু যন্ত্র থেকে অমন মিঠে সুর বেরুতে পারে দেখে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল স্বরাজ। আরো অবাক হয়েছিল ঐটুকু মেয়ের বাজানোর ক্ষমতা দেখে। তারপর কী হয়েছিল মনে নেই তার। বাঁ কানের ওপর একটা প্রচন্ড থাপ্পর খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল সে। জ্ঞান ফিরলে শুনেছে খানসামা নাকি তাকে দেখেছে সায়েবের মেয়েকে সে বদ মতলবে ফোঁসলাচ্ছিল। দেখে ধাপ্পর মেরেছে। সেই থেকে তার ও বাড়িতে যাওয়া বন্ধ। সেই থেকে বাঁ কানে আজ অবধি কিছু শুনতে পায় না লালা স্বরাজ।
ঐ ঘটনার পর ভীষণ এক আক্রোশ আর জেদ জন্ম নিয়েছিল তার মনে। মনে আছে, বাবা তাকে বেরুতে দিতেন না ছুটিবারেও।
একদিন বাবা খুব সাজ পোশাক করে বেরুলেন। বলে গেলেন, দূরে যাচ্ছেন তিনি। এ দুদিন যেন ভালো ছেলে হয়ে স্বরাজ তার চাচার সঙ্গে ঝাড়ামোছার কাজ করে। বাঁদরামো করলে বেঁধে রাখবেন শুয়োরের খোয়ারে।
পরদিন সকালে চাচার সঙ্গে কাজ করেছে স্বরাজ। চাচা হঠাৎ ঝাড়ু থামিয়ে বলল, এই শুনেছিস, তোর বাবা বর সেজে বিয়ে করতে গেছে।
যাহ।
বিশ্বাস হলো না, না? শালা যখন সত্যার হাতে পয়জার খাবি তখন বিশ্বাস হবে। নে বালতি তোল, কাজ কর।
বলেই পেটে এক লাথি। স্বরাজ বসে বসে মেঝে ঘষছিল, ঘোৎ করে মাটিতে পড়ে গেল। বালতি আঁকড়ে ধরে সামলাতে গিয়ে ময়লা পানিতে টাবুটুবু হয়ে গেল ঘর। তার জন্যে সায়েবের কাছে বকুনি খেতে হয়েছিল চাচাকে। বাবা সত্যি সত্যি বিয়ে করে ফিরলেন। চাচা শোধ নিল কথাটা লাগিয়ে। এমনিতেই নতুন মাকে দেখে ভয়ে ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল স্বরাজ। আর বিয়ের তাড়ি খেয়ে বাবার মেজাজ টং। স্বরাজকে ধরে এমন মার মারলেন, সে সেই যে বাড়ি থেকে বেরুলো আর ফিরল না।
বছর খানেক পশুর মতো এদিক ওদিক ঘুরে দশ বছরের স্বরাজ কী করে দৈবচক্রে পড়ে মালের জাহাজে পৌঁছুলো ত্রিনিদাদ। সেখানে সে বুঝতেও পারল না, এক পাদ্রীর পাল্লায়। পড়ে তার দীক্ষা হলো খ্রিষ্টান ধর্মে। এক রুটির দোকানে চাকরি করতে গিয়ে নিঃসন্তান মালিক তাকে নিলেন দত্তক পুত্র। তারই কল্যাণে বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ধাপ পর্যন্ত পড়াশোনা হলো স্বরাজের। রুটির দোকানের মালিক তাকে তার লালা উপাধি ছাড়া আর কিছুই দিয়ে যেতে পারেননি। লালা স্বরাজ তার মৃত্যুর পর দোকান বিক্রি করে লণ্ডনে এসে গায়ে গতরে খেটে শিখলো সাংবাদিকতা।