দরোজায় টোকা দিতেই বেরিয়ে এলো রজনী। যেন এতক্ষণ তার জন্যেই সে অপেক্ষা করছিল। ভেতরে এসে বসল লালা স্বরাজ। বলল, সে সর্বত্র খবর নিয়েছে। এখনো হদিশ মেলেনি। জিগ্যেস করল, আচ্ছা উনি ঢাকা চলে যান নি তো?
না, আমার মনে হয় না।
আশ্চর্য!
কী?
আপনাকে ফেলে কোথায় যেতে পারেন? আমি হাসপাতালেও খোঁজ নিয়েছি।
মাথার ওপরে বিরাট চক্রের মতো বাতি জ্বলছে। সেই আলোয় লালা স্বরাজ দেখল রজনী সারাটা বিকেল কেঁদেছে। তার মুখ কান্না শেষে পাথরের মতো ভার হয়ে আছে। সে বলল, আপনি দেশে ফিরে যান।
চমকে উঠল রজনী। দ্রুত মাথা নাড়ল। অস্পষ্ট উচ্চারণ করল, না, সে হয় না।
কেন?
দেশে আমার কেউ নেই।
কেউ নেই?
যেন প্রতিধ্বনি করে উঠল লালা স্বরাজ।
বাবা মা ভাই বোন কেউ নেই? আপনার স্বামীর কেউ নেই? তারও কেউ নেই?
না।
সে ভাবল মেয়েটা মিথ্যে কথা বলছে। কিন্তু মিথ্যে বলার মতো মেয়ে বলেও মনে হচ্ছে না। একদিকে তার সাংবাদিক মন রহস্য ভেদের জন্যে ব্যগ্র হয়ে উঠল, অন্যদিকে এই মেয়েটার জন্যে মমতা করতে লাগল, সেই মমতা তাকে বারণ করল মেয়েটাকে আর কোন প্রশ্ন করতে। তার মনে হলো রজনী ভেঙে পড়বে।
জীবন যে কী অসামান্য অগোচর এক শক্তির চক্রে আবর্তিত, উৎক্ষিপ্ত, জটিল হয়ে ওঠে, মানুষ তার এক নগন্য ভগ্নাংশও জানতে পারে না, এ কথা লালা স্বরাজ জানে। তার নিজের জীবনটাও তো ওই। কে তার কতটুকু জানে, তাকে কতটুকু কে বুঝতে পারে? এই মেয়েটার কোমল চোখের সমুখে বসে তার নিজের অতীতের ছবি দেখতে পেল লালা স্বরাজ। তার বাবা ছিল করাচি পোর্টের অসংখ্য ঝাড়ুদারের একজন। ছোটবেলার কথা এখনো স্পষ্ট মনে আছে তার। বাবার সঙ্গে সেই ভোরে বেরুতো ভিজে ন্যাকড়া আর বালতিভরা পানি নিয়ে। বাবা ঝাড় দিয়ে যেতেন আর সে ন্যাকড়া ভিজিয়ে ভিজিয়ে মেঝে মুছতো। বাবা বলতেন, মুছতে মুছতে যখন নিজের চেহারা দেখতে পাবি তখন বুঝবি কাম ভালো হয়েছে। মেঝেতে নিজের চেহারা সে কোনদিন দেখতে পায়নি। কথাটা ভয়ে বাবাকে বলত না সে।
সারাদিনের কাজ ছিল এই। সকাল দুপুর সন্ধ্যে। একটা দিন হপ্তায় ছুটি মিলত। কিন্তু বস্তি থেকে বেরুনো ছিল তার নিষেধ। বাবা ভয় করতেন, ছেলে অস্পৃশ্যের সন্তান, পথে বেবিয়ে কোথায় কোন ব্রাহ্মণের ছায়া মাড়াবে, চোখে পড়বে, অভিশাপ কুড়োতে হবে। ভালো করে বুঝতো না স্বরাজ ব্যাপারটা। বাবাকে দেখত বেরুতে। জিগ্যেস করলে তিনি বলতেন, তুই এখনো ছেলেমানুষ, কখন কী করে বসবি, তাই বেরুনো মানা। তখন নিজেকে হাত পা বাঁধা কুকুরের মতো মনে হতো স্বরাজের। ব্রাহ্মণকে মনে হতো অতিমানব। কল্পনা করত দৈত্যের মতো দীর্ঘ তারা, অসুরের মতো শক্তি তাদের, চোখ দিয়ে বেরুচ্ছে আগুন—-যে আগুন তাকে পুড়িয়ে মারবার জন্যে সারাক্ষণ লকলক করছে।
রজনীর কণ্ঠস্বর হঠাৎ কানে এলো!
কী ভাবছেন?
লালা স্বরাজ তার অতীত থেকে ফিরে এসে ধরা পড়ে যাওয়ার হাসিতে বিব্রত হলো। বলল, কিছু না।
রজনী কী বুঝলো, মন ছোট করে বলল, আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি। আমার জন্যে সারাটাদিন আপনার নষ্ট হলো।
না, না, সে কী?
আপনার কি মনে হয়, ওকে খুঁজে পাওয়া যাবে?
যাবে, নিশ্চয়ই যাবে, কেন যাবে না? তারপর কী ভেবে লালা স্বরাজ যোগ করল, মানুষকে খুঁজে পাওয়া যাবে না, কেমন কথা? একমাত্র মরে গেলেই মানুষ সত্যি সত্যি হারিয়ে যায়। বেঁচে যে থাকে তাকে আজ হোক কাল হোক পাওয়া যাবেই। আমার তো মনে হয় উনি নিজেই ফিরে আসবেন। হয়ত আজ রাতেই আসবেন। নিশ্চয়ই কাল রাতে আপনাদের ঝগড়া হয়েছিল?
তার কথা মরমে গিয়ে স্পর্শ করল রজনীকে। পরম একটা নিশ্চিন্ত স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে এলো তার। সত্যি তো মহসিন আজ রাতেও ফিরে আসতে পারে। বরং এইটেই সম্ভব। রজনীর তখন খুব ভালো লাগল। মনটা তার আরো সহজ হয়ে উঠল। সলজ্জ হয়ে মাথা নেড়ে মুখে বলল, না, ঝগড়া কী!
মানুষ বেঁচে থাকলে তাকে খুঁজে পাওয়া যাবেই, এই কথা লালা স্বরাজ বলেছে, কিন্তু সত্যি সত্যি সে কি তা বিশ্বাস করে? তার নিজের জীবনে কি এটা মিথ্যে হয়ে যায়নি। কিন্তু যখন সে বলেছে তখন এত অনুভব করে বলেছে যে তার মন ভীষণ রকমে আচ্ছন্ন হয়ে রইল এক আশ্চর্য কোমলতায়। রজনীকে তার খুব আপন বলে মনে হলো। সুন্দর একটা পরিবেশ রচিত হলো তার হৃদয়ের মধ্যে। সে বলল, সারাদিন ঘরে বসে থাকলে আপনার মন খারাপ করবে যে, কাঁদেন নি তো?
রজনীর ভালো লাগল কান্নার উল্লেখে। লোকটাকে কাছের মনে হলো। সত্যি সে কেঁদেছে। কিন্তু মুখে বলল, না।
তাহলে চলুন, শহরে বেরিয়ে আসবেন। এই সময়টা কার্নিভালের মতো খুশিতে ভরে থাকে বাইরে। যাবেন? আপনার সঙ্গে বাংলায় কথা বলে এই আধঘণ্টায় রীতিমত পণ্ডিত হয়ে গেছি। কেমন বাংলা বলি বলুন তো?
ভালো।
কি, যাবেন?
সারাটা দিন ঘরের মধ্যে ছটফট করেছে রজনী। কতবার যে উঠেছে, বসেছে, শুয়েছে, হেঁটেছে, দাঁড়িয়ে থেকেছে তার ইয়ত্তা নেই। ঢাকা থেকে পালিয়ে আসার সময় বুকের মধ্যে যতটা না কাঁপুনি লেগেছিল, আজ সারা দিনে তার চেয়ে বেশি দুশ্চিন্তা তাকে দুর্বল করে তুলেছে। দুর্ভাগ্য তার নতুন নয়। তিনবার আই এ ফেল করা, কয়েকবার তাকে দেখতে এসে পছন্দ না করা, মা–বাবার বকুনি, এ সব তাকে যথেষ্ট পাথর করে ফেলেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যকে দূর করবার জন্যে পেছনে ফেরার পথ বন্ধ করে শেষ বারের মতো যাকে সে অবলম্বন করেছিল, সে চলে যাবার পর আজ সত্যি সত্যি নিজেকে বড় রিক্ত মনে হয়েছিল তার। রিক্ততা যখন চরমে গিয়ে পৌঁছয়, তখন আশ্চর্য রকমে মানুষ মুক্ত বোধ করতে থাকে। ইন্দ্রিয়ের একটা সহন–সীমা আছে, সেটা পেরিয়ে গেলে দুর্বহ ভারও আর ঠাহর হয় না। রজনীর হয়েছে সেই দশা। তার মনে হলো, জন্মজন্মান্তরে এমন সহানুভূতি সে পায়নি। সে বলল, এখন কি বাইরে বেরুনোর সময় আছে?