আমাকেও আপনি চেনেন না। সে যাক, এখন আমার মনে হচ্ছে ম্যানেজারের সঙ্গে আপনার দেখা করাই ভালো।
কেন?
সে বিষয়ী মানুষ। প্রথমেই তার মনে পড়বে হোটেলে বাকি বিলের কথা। সেটা আপনার মাথায় আরেক বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
রজনী ভাবেনি। এবারে সে চোখে মুখে দিশে দেখতে পেল না। বলল, তাহলে?
একটা কাজ করতে পারবেন? আপনি দোতলায় নেমে ননম্বর কামরায় যান। ওখানে লালা স্বরাজ থাকেন, আমার বন্ধু সাংবাদিক। আমি টেলিফোনে তাঁকে বিস্তারিত জানিয়ে দিচ্ছি। আমার মনে হয়, সে নিশ্চয়ই একটা কিছু করতে পারবে।
তার সমুখেই পীরজাদা টেলিফোন করল লালা স্বরাজকে। স্বরাজ সৌভাগ্যবশত তার কামরাতেই ছিল। আজ তার ছুটিবার। পীরজাদা নিজে রজনীকে দিয়ে এলো লালা স্বরাজের কামরায়। বসলো না। ঘরে এসে পরপর দুটো নির্জলা বড় হুইস্কি পান করল। রজনীর কথা বারবার মনে পড়ছে অথচ সে মনে করতে চায় না। রজনীর জন্যে তার প্রচণ্ড কষ্ট হচ্ছে, অথচ কষ্টটাকে কিছুতেই দাবিয়ে রাখা যাচ্ছে না।
লালা স্বরাজ বাঙালি মেয়ে শুনে উৎসাহ বোধ করল। কিছুদিন হলো বাংলার জন্যে তার একটা অনুরাগ দেখা দিয়েছে। সেটার শুরু রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর সময়ে। কিনেছিল নৃত্যনাট্য শ্যামার রেকর্ড। বুঝতে পারেনি একবর্ণ, কিন্তু ভাষাটার প্রতি ভালোবাসা জন্মে গেল। কেনা হলো সুনীতি বাবুর বাংলা শেখার বই। ভাষার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার সংস্কৃতি, মানুষ সব কিছুর জন্যে আগ্রহটা প্রবল হলো তার।
এতদিন একটি মেয়ে, বাঙালি মেয়ে এ হোটেলে আছে এটা সে জানে না ভেবে অবাক হলো। সে পীরজাদাকে টেলিফোনে বলল, তুমি এখুনি ওকে নিয়ে এসো।
পীরজাদা এসে রজনীকে পৌঁছে দিয়ে গেল তার কামরায়। আড়ালে ডেকে বলল, থানা পুলিশে খবর দিয়ে অনর্থক হাঙ্গামা বাধানো রজনী পছন্দ করছে না। তুমি সাংবাদিক মানুষ, যে করে হলে হৈচৈ কম হয়, লোকটার সন্ধান এনে দাও।
রজনীকে দেখে প্রথমেই যে কথাটা মনে হলো লালা স্বরাজের তা হচ্ছে মেয়েটা বোকা। শিশুর মতো একটা মমতা মাখানো সারা মুখে। রবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলির ছবি খুঁজে পেল সে। আরো ভালো লাগল, একেবারে নতুন লাগল, তার পরনে নানা রংয়ের বরফি করা তাঁতের সবুজ শাড়িটা।
সাংবাদিক মানুষ লালা স্বরাজ। তার দৃষ্টিই আলাদা। প্রথম পরিচয়ের আবেশটুকু পার হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সে রজনীকে পরিমাপ করল। জিগ্যেস করল, এ হোটেলে কদ্দিন?
দেড় মাস।
করাচিতে এই প্রথম?
হ্যাঁ।
আপনার স্বামী?
রজনী চোখ তুলে তাকাল। বলল, হ্যাঁ।
এতক্ষণে রজনীর মনের মধ্যে একটু সাহস দেখা দিচ্ছে।
লালা স্বরাজ আচমকা প্রশ্ন করল, আপনার কি মনে হয় আপনি সত্যি কথা বলছেন?
কোনটা!
যে উনি আপনার স্বামী?
কথাটা বলে লালা স্বরাজ উঠে দাঁড়াল। বেল টিপল। বেয়ারা এলে তাকে চায়ের জন্যে পাঠাল। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে রজনীকে বলল, আমার ধারণা, উনি আপনার স্বামী নন। রজনী প্রতিবাদ করতে গেল। কিন্তু কী বলল ভালো করে বোঝা গেল না। বাংলা উর্দু ইংরেজি মিশেলে সব তালগোল পাকিয়ে গেল। নাজেহাল হয়ে বলল, আমি আপনাদের ভাষায় ভালো করে কথা বলতে পারিনে। আমি কিছুই বুঝিয়ে বলতে পারছি না।
লালা স্বরাজ বলল, আপনি বাংলাতেই বলুন। ইদানীং আমি আপনাদের ভাষা শেখবার চেষ্টা করছি। বলতে না পারলেও মোটামুটি বুঝতে পারি।
কিন্তু রজনী আর কিছু বলতে পারল না। লালা স্বরাজ বুঝতে পারল রজনীর স্বামী নয়। তবু একসঙ্গে একই হোটেলের কামরায় দেড়মাস তারা থেকেছে। রজনীর রূপে নেই প্রখরতা, দৃষ্টিতে নেই বিদ্যুৎ, ভঙ্গিতে নেই আজাদ–জেনানার দম্ভ। রজনী শান্ত, আত্মস্থ, নির্ভরশীলা নারী। তবে কি সে ভালবাসত লোকটাকে? আর এই ভালবাসাই তাকে আকুল করে তুলেছে পালিয়ে যাওয়া লোকটার সন্ধানে সম্পূর্ণ অপরিচিত পুরুষের কাছে সাহায্য চাইতে? কুণ্ঠাহীনা করেছে? আর লোকটা যদি সত্যি সত্যি ভালোবেসে থাকত রজনীকে, তাহলে পালিয়ে গেল কেন? কেন ওরা এসেছিল করাচিতে? কেন এ হোটেলে উঠেছিল? রজনীর দিকে আবার ভালো করে তাকাল লালা স্বরাজ। কিছুই বোঝা গেল না। তার একটা প্রশ্নেরও উত্তর সেখানে নেই। কেবল লোকটার জন্যে ভালবাসার স্পন্দন যেন মেয়েটার মধ্যে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে।
এমন কাণ্ড সে জীবনে দেখেনি। ভালবাসার এই পরোক্ষ পরিচয়ে বিস্মিত হলো সে। বলল, কিছু মনে করবেন না। আমারই বুঝতে ভুল হয়েছিল। কাল অধিক রাত অবধি কাজ করতে হয়েছে, মাথা গুলিয়ে আছে। আপনার স্বামীর সন্ধান আমি যথাসাধ্য করব। আশা করি সফল হবো। আপনি ঘরে যান। দরকার হলে আমাকে খবর দেবেন।
রজনী চলে গেলে সে ভাবতে বসলো, সন্ধানটা কিভাবে নেয়া যেতে পারে। মহসিনের চেহারা তার জানা নেই, একটা ছবি পেলে কাজ হতো। তক্ষুণি সে রজনীর কামরায় এসে ফটো চাইল। মেয়েটা অনেকক্ষণ সুটকেস খুঁজল, মহসিনের কাগজপত্র ঘাটলো, কিন্তু ছবি পাওয়া গেল না। বলল, তাহলে?
কোনো রকমে একটা বর্ণনা দিল তার। লালা বেরিয়ে এসে কী ভেবে পীরজাদার দরোজার দিকে গেল। দেখল, ঘর বন্ধ। পীরজাদা বেরিয়ে গেছে।
সন্ধ্যের সময় ফিরে এসে লালা স্বরাজ দেখল, তখনো পীরজাদার ঘর বন্ধ। দুপুর থেকে শহরের সর্বত্র তার যেখানে যত বন্ধু আছে সবার কাছে সে ঘুরেছে পুলিশের ছোট বড় কর্তা থেকে শুরু করে হাসপাতাল, হোটেল, বাঙালিদের আড্ডা, ক্লাব, সংঘ কিছুই বাদ রাখেনি। কিন্তু সে নিজেও জানতো, এ করে কিছুই হবে না। একটা সুস্থ সজ্ঞান লোক এত বড় শহরে গা ঢাকা দিয়ে থাকলে তাকে খুঁজে বার করা শক্ত। হয়ত আদৌ সে এ শহরেই নেই। হয়ত ঢাকা চলে গেছে। কিন্তু গেল কেন রজনীকে ফেলে?