প্রবীর বসে বসে সিগারেট টানছে। আলোয় ধিকিধিকি জ্বলে উঠছে তার চোখ। কখনো কখনো মাথা ফিরিয়ে দেখছে নাসিমাকে, তারপর আবার দূরে দূরে মানুষ, মানুষের ওপরে আকাশকে। নাসিমা মনে মনে বলল, আমি তোমাকে আজ বৃষ্টির মুহূর্তে চৌরঙ্গির রেস্তোরাঁয় সৃষ্টি করেছি।
বাসায় পৌঁছে দিল প্রবীর। তখন অনেক রাত। প্ৰবীর বলল, আজ ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না, কী করি বলুন তো।
আমি কি ফিরিয়ে দিচ্ছি আপনাকে?
আহা তা কেন? বসবো কিছুক্ষণ? একটু চা খাওয়াবেন?
খাবেন? আসুন।
বলতে বলতে দুজনে গিয়ে বাইরের ঘরে ঢুকলো। বাতিটা জ্বেলে দিতেই অন্ধকারে–বিশাল কামরাটা ছোট হয়ে এতটুকু হয়ে গেল যেন।
প্রবীর সোফায় বসে টিপয়ের ওপর পা তুলে দিয়ে ক্লান্তিতে আড়মোড়া ভাঙ্গল। পরে বলল, অনেকক্ষণ পরে হাত পা ছড়িয়ে বসতে পেয়ে যেন মুক্তি পেলাম।
কৌতুক–অভিযোগে স্বচ্ছ হয়ে এলো নাসিমা।
এতক্ষণ তাহলে শুধু শুধু আমার জন্যে কষ্ট পেয়েছেন বলুন।
কষ্ট? তা পেলামই বা। এই কিছুক্ষণ আগে ছেলেমানুষের মত একটা প্রতিজ্ঞাও করে ফেলেছিলাম মনে মনে।
কী রকম?
আপনার জন্যে মনে হচ্ছিল আমি যে কোনো কষ্ট করতে পারি।
তাই নাকি?
যেন কিছুটা অভিমান ভরা কণ্ঠে প্রবীর বলল, ঠাট্টা মনে করলেন?
প্রবীরের এই অভিমানটুকু মধুর লাগল নাসিমার। প্রবীর নিচু হয়ে সিগারেট ধরালো আরেকটা। নাসিমা বলল, চা খাবেন বলছিলেন? আপনার চা করে আনি।
অনেকক্ষণ পরে খালি হাতে ফিরে এলো নাসিমা। বলল, কপাল মন্দ আপনার, অতিথিকে যত্ন করতে পারলাম না। চা পাতা নেই ঘরে। কী করবেন?
থাক, না হলেও চলবে।
তাহলে বসুন আরো কিছুক্ষণ।
আসলে নাসিমার ফিরতে দেরি দেখে প্রবীর উঠে ঘরময় পায়চারি করছিল। নাসিমা তার মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বসলো অবশেষে।
বসবেন না? দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি?
বসে থেকে পায়ে ঝিঁ ঝিঁ ধরে গিয়েছিল। হাঁটছি খানিকটা।
দাদাকে দেখে এলাম, ওখানে দেরি হয়ে গেল।
কেমন আছেন উনি?
ওই রকমই। একটু বেড়েছে মনে হলো।
ব্যথা?
হ্যাঁ। ডাক্তার সন্ধ্যেয় ইঞ্জেকশান দিয়ে গেছে শুনলাম। এখন ঘুমোচ্ছে।
রাত বেশ হলো, না? আজ সারাটা দিন কাটালাম আমরা। বলতে বলতে প্রবীর এসে বসলো তার সমুখে। বলল, কথা বলুন। কিছু বলুন।
কী বলব?
আপনার কথা। আপনার সব কথা আমাকে বলুন, আমি শুনবো।
কষ্ট পেতে চান?
প্রবীর অস্পষ্টভাবে নাসিমার হাতে হাত রাখলো।
চাই।
হামেদকে যখন দেখতে গেলাম, নাসিমা ভাবল, তখন সে কত অসহায় হয়ে ঘুমোচ্ছিল। প্রবীরের চোখের দিকে তাকাতে পারল না নাসিমা। হঠাৎ নিজেকে বড় অসহায় মনে হলো তার। দুর্বল একটা হাসি ছড়িয়ে ভাঙ্গা গলায় বলল, তারচে গল্প শুনুন, কিসের গল্প বলবো? প্রবীর কোনো কথা বলল না। স্পর্শ সরিয়ে নিল না।
—-আমি তখন খুব ছোট। আমার মনে আছে একদিন খুব বড় বড় শিলাবৃষ্টি হলো। ছোটবেলার গল্প শুনতে আপনার ভালো লাগে? আমাদের দেশের বাড়িতে সবকটা ঘরই টিনের।
প্রবীর এবার তার মনিবন্ধে তার রাখলো।
নাসিমার কণ্ঠ হঠাৎ দ্রুত দুর্বল হয়ে এলো—-টিনের ছাদে কখনো শিল পড়ার আওয়াজ শুনেছেন? শোনেননি? ইংরেজি রেকর্ডের সোলা ড্রাম পিসের মত আরো জোরে আরো তীব্র। বীভৎস, বুক স্তব্ধ করা।
প্রবীরের হাত কী উষ্ণ। কাঁপছে, প্রবীর তোমার হাত কাঁপছে।
ভয়ে নাসিমা উঠে দাঁড়াল, যেন কেউ তাকে জোর করে উঠিয়ে দিল আসন থেকে। সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল প্রবীর পাহাড়ের ঢালে গড়ানো একটা পাথরের মত। নাসিমা বন্ধ করতে পারল না তার কথা। যেন এ সমস্ত কথা সে নিজে উচ্চারণ করছে না; অন্য কেউ তার ভেতর থেকে করছে, তার কোনো হাত নেই।
—-এত ভয় পেয়েছিলাম সেদিন—-নাসিমা হাসতে চেষ্টা করল—-যে খাটের তলায় গিয়ে লুকিয়েছিলাম।
প্রবীর, তোমার চোখে আগুন।
প্রবীর তাকে দুহাতে বুকের পাথরে পিষে ফেলল।
না—-না—-প্রবীর।
কিন্তু আমি কেন স্তব্ধ হতে পারছি না? আমি কেন বলে চলেছি—-বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরও বেরোইনি। এত ভয়।
প্রবীর ঠোঁট দিয়ে খুঁজলো তার ঠোঁট। আমি ঠোঁট সরিয়ে নেব, আমাকে কথা বলতে হবে। কথা—-কথা।
—-শেষে আব্বা আমাকে জোর করে টেনে বের করেছিলেন খাটের তলা থেকে। বলেছিলেন
প্রবীর তার বাঁ হাত দিয়ে ব্লাউজের মুক্তি খুঁজছে।
নাসিমা চিৎকার করে উঠলো এই প্রথম —- প্রবীর।
ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল তাকে। প্রবীরের মুখ অবাস্তব হয়ে উঠেছে। তাকে চিনতে পারলো না নাসিমা। আমি তোমাকে কোনদিন দেখিনি।
যান, চলে যান আপনি। আমার জন্যে কাউকে আর কষ্ট পেতে হবে না।
মিথ্যে, শুধু মিথ্যে।
পালাও, নাসিমা, পালাও।
এই স্তব্ধতা কি এক মৃত্যু থেকে আরেক জন্মের মধ্য–শূন্যতা?
নাসিমা অনেকক্ষণ ধরে গোসল করল। তবু যেন কণামাত্র মুছে ফেলতে পারল না প্রবীরের স্পর্শ।
.
চারদিন পরে হামেদ মারা গেল তার ঘুমে। তার মৃত্যু যে একটা মুক্তি এনে দিল নাসিমাকে। একমুহূর্তে সমস্ত ক্ষোভ আর ক্লেদ মুছে গেল আত্মা থেকে। আমার অনুতাপ নেই, প্রতীক্ষা নেই, আমি নির্মল একা। গোরস্তান থেকে ফিরে এসে হামেদের শূন্য বিছানায় বসলো সে। একটা মানুষ মরে গেলে তার কামরা সহসা এত বিশাল হয়ে যায় কেন?
শূন্যতা কেন স্পন্দিত হয়ে উঠতে চায় বারবার?
সেই বিশালতায় দাঁড়িয়ে নাসিমা মনে মনে উচ্চারণ করল, আমি তোমাকে করুণা করি, প্রবীর। এবারে আমি চলে যেতে পারি।