- বইয়ের নামঃ অনুপম দিন
- লেখকের নামঃ সৈয়দ শামসুল হক
- প্রকাশনাঃ মাওলা ব্রাদার্স
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
১. প্রথমে দেখেছিল বীথি
অনুপম দিন – উপন্যাস – সৈয়দ শামসুল হক
প্রথমে দেখেছিল বীথি। দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিল। লোকটা কী রক্তিম চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। যেন অন্তর পর্যন্ত তার দৃষ্টির কিরণ এসে বিঁধছে। তখন দুপুর বেলা। মাথার পরে খাড়া রোদ। শরীর খারাপ বলে আজ আর কলেজে যায় নি বীথি। অবশ্যি শরীরটা যে তার সত্যি সত্যি খারাপ ছিল, একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। কারণ, কলেজের গাড়ি আসার একটু আগেও তাকে দেখা গছে কলেজে যাবার উদ্যোগ করতে। তারপর হঠাৎ কী হলো কে জানে। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে ঘরে এসে দেখেছিল, আবু তার খাতায় লিখে গেছে—- আমার নাটক দেখতে তুই না এলি তো বয়েই গেল। আমি কি তোর জন্যে নাটক করছি? যা কলেজে, গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে থাক বইয়ের ওপর।
আবু ইউনিভার্সিটিতে নাটক করছে। বীথিকে যেতে বলেছিল রিহার্সেলে। লজ্জা করেছে বীথির। মাথা নেড়ে বলেছিল, না। সেটা শুনে দুমদুম করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে আবু। তারপর এই চিঠি। তাতেও কিছু হতো না। বই নিয়ে খোটা দেয়ায় ভীষণ অস্বস্তি হলো তার। চাচিমাকে গিয়ে বলল, গাড়ি এলে ফেরত পাঠিয়ে দিও। আজ যাবো না।
চাচিমার কাছে আজ আড়াই বছর আছে বীথি। এই আড়াইটে বছরে এই ছায়া–ছায়া, কম কথা বলা, মায়া পরানো মেয়েটাকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবেসে ফেলেছেন। হাতের রান্না ফেলে তিনি বললেন, কেন?
তাঁর উদ্বিগ্ন স্বর শুনে সংকুচিত হলো বীথি। যেন কিছু না, তাই সাহস দেয়ার জন্যে হেসে উত্তর করল, ভালো লাগছে না।
কী রে?
শরীরটা।
চাচিমা এক পলক তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। কী বুঝলেন, বললেন, তবে থাকগে, তোর কলেজে গিয়ে কাজ নেই।
তখন পরম স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে বীথি গিয়ে ডুবেছে নিজের ঘরে।
খাতার যে পাতায় আবু লিখেছিল সেটা কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলে তবে নিশ্চিন্ত হলো সে। তারপর দুপুরে চাচিমার সংগে খেতে বসেছে বীথি। মরিয়মের কাছে তার মনের দরোজাটা ছিল ভীষণ রকমে খোলা। একবার ভেবেছিল, আবুর কথা বলবে। ঠিক তখন বাধা পড়ল। মরিয়ম বললেন, আচ্ছা বীথি, তুই যে রান্নাবান্না কিছু শিখলিনে, তোর বাবা আমাকে কী বলবে বলতো।
কেন? কী আবার বলবে?
বিয়ে হলে কী করবি? বেঁধে খাওয়াতে হবে না?
বীথি হঠাৎ তার পাতের দিকে মনোযোগ নাবিয়ে এনে প্রসঙ্গটা বদলাতে চায়। বলে, তুমি কিন্তু সব আমাকে দিয়ে দিচ্ছ, চাচি মা। এইটে নাও, এইটে নাও, আমি আর কিছু নিচ্ছি নে। বীথি বাটি উপুড় করে ঢেলে দেয় মরিয়মকে। কিন্তু তাঁর যেন তখন ঘোর লেগেছে। বীথির দিকে মায়া চোখে তাকিয়ে তিনি বলে চললেন, ছুটির দিনে তুই আমার সংগে রান্না করবি। রান্না না করলে কাছে বসে থাকবি। নইলে তোর বাবার কাছে নালিশ করে দেব।
দিও, যতো পার দিও তুমি।
খাবার ঘরের বাইরে নিম গাছটায় তখন খুশির রোদে ঝিলিমিলি লেগেছে। বীথির মনোযোগ তখন সেদিকে।
এমনি ছিল দুপুরটা।
দুপরে শুয়ে শুয়ে বই পড়া চলছিল বীথির। পানির তেষ্টা পাওয়াতে নেবে এসেছিল রান্নাঘরে। সারাটা বাড়ি তখন কেমন ঘুম ঘুম করছে। চাচা গেছেন অফিসে। চাচিমা শুয়ে আছেন পাখা ছেড়ে দিয়ে। নিম গাছটা নিথর হয়ে আছে। রান্নাঘর থেকে কী মনে করে বসবার ঘরের বারান্দা দিয়ে ঘুরে আসতে গিয়েছিল বীথি। সেই তখন।
দেখে, একটা মানুষ, একমাথা রুখু চুল তার, চোখের কোলে কালিমা, কেমন চেনা চেনা—-সোফার ওপর দুপা তুলে নিবিষ্ট মনে কাগজ পড়ছে। বুকের ভেতরটা এক মুহূর্তে যেন পাথর হয়ে গেল বীথির। লোকটা তার পদশব্দে কাগজ সরিয়ে বীথির দিকে তাকিয়ে রইলো, যেন তাকে তন্ময় থেকে ফিরিয়ে এনে ভারী অন্যায় করেছে সে।
বিব্রত হয়ে চলে যাচ্ছিল কী যাবে, তখন লোকটা বুকের কাছে হাঁটুজোড়া আরো নিবিড় করে টেনে এনে বিড়বিড় করে বলল, আমাকে একটু পানি দিতে পারো?
যেন এক জীবনের বিনিময়ে পানি চাইছে লোকটা।
মরিয়ম আলুথালু বেশে ছুটে এসে পাগলের মতো জড়িয়ে ধরলেন হাশেমকে। বললেন, বাবা, তুই এতদিন কোথায় ছিলি? এতদিন পর মায়ের কথা মনে পড়লো সোনা আমার। তার পেছনে পানির গেলাশ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বীথি। পাঁচ বছর পর বাড়ির বড় ছেলে এমন করে ফিরে আসবে, আজ সকালেও তা কে ভেবেছিল? হাশেমকে অনেক ছোটকালে দেখেছিল বীথি। সে দেখার সংগে কোন মিল নেই লোকটার। যেন একটা রাস্তার মানুষ উটকো এসে হাজির হয়েছে। বীথির বুকের মধ্যে কেমন দুপদুপ করতে থাকে, খানিকটা ভয়ে, অনেকখানি আনন্দে।
হাশেম কিন্তু মায়ের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করবার জন্যে এলোপাথারি হাত প ছুঁড়ছে। মুখে বলছে, আহা ছাড়ে। ছাড়ো না। কী শুরু করেছ?
তখন শান্ত হলেন মরিয়ম। তাকে ছেড়ে দিয়ে বললেন, ছাড়বোই তো বাবা। ছেড়ে তো দিয়েই ছিলাম। আবার তবে জ্বালাতে এলি কেন?
মরিয়মের কণ্ঠে কান্না আসতে চাইছে। সেটাকে তিনি আঁচলের মধ্যে লুকোলেন।
হাশেম তখন খুব আস্তে উচ্চারণ করল, হাসল, তোমাকে জ্বালিয়ে সুখ আছে, মা। তুমি জ্বলবে, কিন্তু কিছু বলবে না। আর আমি? জ্বলে যাচ্ছি, চীৎকার করছি।
বলতে বলতে হাশেম ঝটকা মেরে সোফা থেকে উঠে দাঁড়াল। যেন একটা দীর্ঘ সৌন্দর্য রেখার জন্ম হলো হঠাৎ। যেন পা থেকে মাথা অবধি একটা শেকল বাধা শক্তি মুক্তি পেয়ে ঋজু হয়ে দাঁড়াল। গাঢ় বেগুনি রঙের খদ্দরের পাঞ্জাবি আর ময়লা পাজামা, স্যান্ডেল। তবু মনে হলো রাজার পোশাক পরে দরবারে যাবার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে হাশেম। দ্রুত বারকয়েক পায়চারি করল সে। মরিয়মকে উপেক্ষা করে, বীথির দিকে না তাকিয়ে, তাদের সমুখে থেকেও যেন অনেক দূরে দাঁড়িয়ে, খানিক হাঁটল হাশেম। একবার দাঁড়িয়ে পেছনে হাত বেঁধে মাটির দিকে চোখ রেখে কী ভাবল। তারপর আবার এক সর্বস্ব ধরে টান দেয়া অস্থিরতার তাড়ায় ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা হাঁটতে হাঁটতে বলতে লাগল, তোমাকে জ্বালিয়ে সুখ আছে, মা। পাঁচ বছর আগে একটা নেশার মতো পেয়ে বসেছিল—- বুকের আগুন দিয়ে বিশ্বসংসারকে জ্বালিয়ে মারব। ঠিক এইখানটায়, দ্যাখো মা–মরিয়মের সামনে এসে হাত দিয়ে নিজের হৃদয়টাকে ইঙ্গিত করে হাশেম। বলে, সারাক্ষণ একটা আগুন। জ্বলছিলো। মস্ত বড় আগুন। মনে করেছিলাম, সব কিছু পুড়িয়ে মারব এ আগুনে। কিন্তু পারলাম কই, মা? হাজার হাজার মানুষ দেখলাম। তারা সবাই কী বলল, জানো? বললো, সাধু বাবা, বুকের ভেতরে আগুন জ্বলছে, তাকে নিভিয়ে দিতে পারো? হাজার হাজার মানুষ। আমার পা ধরে যখন কাঁদত, বলতাম—- ভাগ, পালা এখান থেকে। তবু কি ছাড়ে ওরা? ইস, একেকটা মানুষ ভেতরে ভেতরে, শরীরে চামড়া–মাংসের দেয়ালের ওপারে, দোজখ থেকে সব লকলকে আগুন নিয়ে এসেছে। আমি তার কী করব? একজনকে পা টেনে লাথি মারতে গিছলাম, পা উঠলো না।