কৈশোর পেরুনো সেই প্রথম বয়সটাই অদ্ভুত একটা অহংকার সঞ্চারিত করে দিত যেন এই প্রশংসাটুকু। করাচির সেই দুকামরার ফ্ল্যাটে ডাক্তারের ওখান থেকে ফিরে আসবার পর তার এই কথাটা অনেকক্ষণ ধরে মনে পড়েছিল। জওয়াদ ট্যাকসির ভাড়া দিয়ে ওপরে ওঠে এলে পর তার মনে হয়েছিল প্রাণের সমস্ত দরদ ঢেলে কেউ যদি আজ গান গেয়ে উঠে তবু এই দূরত্ব ভরে উঠবে না। এত দূর এত দূরত্ব আমার। কে যেন বলেছিল আমার মুখ আকাশের মত। বাইরের রঙটাই শুধু নয়, আমার মনও যে তেমনি সুদূর হয়ে গেছে, আনিস কি তা বুঝতে পেরেছিল? না কি জওয়াদও বুঝতে পারে এ কথা? আমি যে আকাশের মত দূর থেকে প্রীতিতে নত হয়ে তোমাদের মিছিল দেখে চলেছি আজীবন দিনগুলি।
আকাশের মত নাসিমার মুখ।
আজ সে মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে বার থেকে। ফ্যাকাশে ছাই ছাই একটা আভা এসেছে। গালের হাড় স্পষ্ট হয়ে ওঠায় দুচোখের তীক্ষ্ণতা যেন বেড়ে গেছে, আর রেখা রেখা জ্যামিতিক চেহারায় ওই বৃত্ত দুটো যেন বিদ্রোহ করে আছে সারাক্ষণ। সারাটা মুখে কোনো সঙ্গতি নেই। একেই কি বলে বীভৎসতা? বত্রিশ বছরের ফসিল এই মুখ এতকাল পৃথিবীর কোন গোপনে লুকোনো ছিল, অনেক নাসিমার মৃত্যুর পর সে তার সময় বুঝে বেরিয়ে এসেছে বিবর থেকে।
মতির মা–র কণ্ঠস্বরে হাতটা কেঁপে গেল গলায়। পাটা ডিবেয় রাখতে রাখতে সে উঠে দাঁড়াল।
আজ আবার সে আরজুর শাদা শাড়িটা পরেছে। যেন অদৃশ্য রূপোর রেকাবি থেকে উথিত গাঢ় ধুপরেখা বাতাসে স্থির হয়ে আছে।
মুখ ফেরাতে গিয়ে কেমন সংকোচ হলো নাসিমার। মতির মা তার এই বারবার নাওয়াটাকে মোটেই যে ভালো চোখে দেখতে পারছে না, এ সে প্রথম দিনেই বুঝে নিয়েছে তার হাসি থেকে। এখন যেন হঠাৎ চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে গেছে নাসিমা।
কিন্তু আজ আমাকে স্নিগ্ধ রাখতে হবে আমার মন। আরজুর বারান্দার শাদা শাদা ফুলের মত, কলকাতার ফুটপাতে কেনা রজনীগন্ধার টিউবের মত।
নাসিমা ঘুরে দাঁড়াল।
না, এখন আমি চা খাবো না। পরে দিবি।
উনুনে পানি দিয়েছি যে।
তোর কি আর কোনো কাজ নেই, মতির মা? আরজু বলে গেছে বলে আমাকে নিয়ে এমনি করে পড়তে হয়? পানি ফেলে দেগে যা, চাচাস নে।
চাঁচালাম কই আপামনি, জিজ্ঞেস করছিলাম শুধু।
তারপর একটু থেমে, —-ওই সাহেব আসবার কথা আছে বুঝি?
নারী হলেই কি অনুভূতি এত প্রবল হতে হয়?
সেদিন মতির মা–কে দিয়ে ফুল পাড়ানোর কুফল ভুগতে হচ্ছে নাসিমাকে, শুনতে হচ্ছে ইঙ্গিত, দেখতে হচ্ছে চাপা হাসির বিচ্ছুরণ। মনে হলো ঠাস্ করে একটা চড় বসিয়ে দেয় মতির মা–র গালে।
আর একটু পরে বেবি আসবে তার উজ্জ্বল দুই চোখ নিয়ে। তার মসৃণ করে কামানো তরুণ গালে সন্ধ্যের আলো এমন একটা নীল আভার সৃষ্টি করবে যে বারবার ইচ্ছে করবে সেখানে আলতো করে একটা চুমো দিতে।
বেবি আসবে। আমার জন্যে সে আসবে। বেবি আসবে। বেবি এক্ষুণি আসবে।
রাতে প্লেন এলো ঢাকা বিমানবন্দরে।
জানালা দিয়ে অনেক আগে থেকেই দেখা যাচ্ছিল বিন্দু বিন্দু আলো—-নিচে, অন্ধকার শহরে। বব জানালা থেকে ক্লান্ত চোখ ফিরিয়ে শুধালো, ইজ দ্যাট ডাউন দেয়ার হোয়ার উই গো? ইয়েস, ডার্লিং।
সংকেত।
নাসিমা ববের সিট বেল্ট লাগিয়ে দিল। তারপর নিজেরটা। ববের মাথা ব্রাশ করে দিল খানিক আঙুল দিয়ে। বব বলল, আই স্লেপট লং।
ইউ ডিড।
হ্যাভ আই মিস্ড এ্যানি ফান?
নাসিমার হৃদস্পন্দন মুহূর্তের জন্যে দ্রুত হয়ে আবার স্বাভাবিকতা ফিরে পেল। আমি মনে করেছিলাম, তুমি মরে গেছ, বব। আমি বোধহয় চিৎকার করে উঠেছিলাম। সবাই মুখ টিপে হাসছিল অনেকক্ষণ। শুনে তুমিও কি হেসে উঠবে, বব? না, কোনদিন তুমি জানবে না।
নো ডিয়ার, ইউ হ্যাভ মিস্ড এ্যানিথিং—-দেয়ার ওয়াজ ক্লাউড অ্যান্ড সান অ্যাণ্ড ক্লাউড এগেন অ্যাণ্ড ইউ কুড সি ডাউন বিলো—-রিয়ালি দেয়ার ওয়াজ নো ফান।
মাটির স্পর্শ শিহরণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে সারা প্লেনে। দৌড়তে থাকে রানওয়ে দিয়ে। দুদিকে পাল্লা দিয়ে যেন অন্ধকার আর গাছ ছুটে চলেছে। আর বাতাস যেন বদলে গেছে হঠাৎ। নাসিমার মন তখন বিষ হয়ে আসছে। যে উত্তেজনা নিয়ে করাচি ফেলে এসেছিল সে কখন যে সেটা অন্তর্হিত হয়েছে তা বুঝতে পারেনি। আবার তাকে আবিষ্কার করে নিতে হবে দ্বীপ। আবার কি তাকে পালাতে হবে?
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ববকে হারিয়ে ফেলল নাসিমা।
চারদিকে আকুল হয়ে খুঁজেও ববকে যখন পেল না তখন মনে হলো একটা শক্তি অন্তর্হিত হয়ে গেছে তার শরীর থেকে। মৃত্যুর শীতলতা সে অনুভব করতে পারলো হৃদপিণ্ডে।
কাস্টমসের পাল্লা চুকিয়ে হলে এসে দাঁড়াতে চোখে পড়ল ববকে। বব হৈহৈ শুরু করে দিয়েছে এরি মধ্যে ছোট ছোট তিনটে ছেলেমেয়ের সঙ্গে। ওর বাবা, নতুন মা দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। হাসছে।
পাশ কাটিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে এলো নাসিমা।
বব যেন আমাকে দেখতে না পায়।
.
বৃষ্টির পরে সারা কলকাতা নতুন একটা পয়সার মত ঝকঝক করছে। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তারা সন্ধ্যেটাকে আবাহন জানাল। মনে মনে। তারপর কার্জন পার্কে গিয়ে। পাশাপাশি বসলো দুজন। এতক্ষণ কেউ কোনো কথা বলেনি, বলল না। নাসিমা এতটা অন্তরঙ্গ বোধ করছে আজ প্রবীরের সঙ্গে যে শব্দের আদান–প্রদানটাই বাহুল্য মনে হচ্ছে তার কাছে। প্রবীরকে বিশ্বাস করেছে সে, এর চেয়ে বড় আর কী হতে পারে? আমার শরীরে আজ কোনো জ্বালা নেই, আমি হয়ত আজ ঘুমোতে পারব ঘুমের ওষুধ ছাড়াই।