প্রবীর কোনো কথা বলল না।
আমি কার কাছে কী এমন অপরাধ করেছিলাম যে আমাকে এমনি করে কষ্ট পেতে হবে?
কেন আপনার এত কষ্ট?
কেন?
ছায়া ছায়া হাসলো নাসিমা। যেন বিষাদ বৃষ্টি হলো। বলল, একেক জন বুঝি এমনি কষ্ট পাবার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। বিনতার গান গাইবার মত হয়ত আমারও এ কষ্ট পাবার প্রতিভা। নইলে এমন হয় কেন?
নাসিমাকে আজ যেন পেয়ে বসেছে। বাইরের অবিবল বৃষ্টি ধারার মত তার মনের দুয়ার খুলে গেছে।
প্রবীর আস্তে আস্তে আঙ্গুল স্পর্শ করে নাসিমার।
নাসিমা তার স্পর্শ সরিয়ে দেয় না। হয়ত তার বাইরের ইন্দ্রিয়গুলো এমন স্তব্ধ হয়ে গেছে যে সে বুঝতে পারেনি প্রবীর কখন তাকে স্পর্শ করেছে। প্রবীর কি নাসিমার ভেতরে এই স্পর্শ দিয়ে সঞ্চারিত করে দিতে চায় তার আত্মিক শক্তি?
নাসিমা অনেকক্ষণ পরে উত্তর করে, মানুষ এত নীচ হয় কেন বলতে পারেন?
প্রবীর উত্তর দিল না।
—-এত নীচ, এত অসুস্থ কেন মানুষ, বলতে পারেন প্রবীর বাবু?
প্রবীর কোনো কথা বলে না। মাথা নিচু করে নাসিমার আঙ্গুল নিয়ে অস্পষ্ট খেলা করতে থাকে।
নাসিমা এবারে হাত টেনে নেয়। বলে, জানি এ সব প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না, জিজ্ঞেস করে শুধু শুধু আপনাকে বিব্রত করলাম।
আমি আপনার প্রশ্নটাই ভাবছিলাম। আসলে আমরা হয়ত সবাই খুব স্বার্থপর, নিজের দিকটাকে বড় করে দেখতে গিয়ে অহেতুক আরেকজনকে ছোট করে ফেলি, তাকে কষ্ট দি তার কষ্ট বুঝতে চাই না।
আর অসুস্থতা?
কিসের? শরীরের না মনের?
শরীরের অসুখ অনেক ভালো প্রবীরবাবু। স্বার্থপরতাও কি একটা অসুখ নয়? এ অসুখটা আরেকজনকে শুছু কবরে নিয়ে যায় যে।
প্রবীর কোমল হয়ে ওঠে।
আপনি অনেক আঘাত পেয়েছেন জীবনে। আমার একটা কথা মনে হচ্ছে। বলবো?
বলুন—-কী কথা?
আমার কী মনে হচ্ছে জানেন, কারো অসুখ তবে আমরা ঘৃণা করি না ওষুধ দিয়ে তাকে সারিয়ে তুলি। মনের অসুখ হলে কেন তাকে ঘৃণা করবো তাহলে?
আমি তো কাউকে ঘৃণা কবিনি, প্রবীরবাবু।
এই উত্তরটা মুখে দিলেও, মনে মনে নাসিমা প্রবীরের কথাটা নিয়ে বিশদ ভাবতে থাকে। প্রবীর বলে চলেছে, আমি জানি, আপনার মত মানুষ কাউকে ঘৃণা করতে পারে না। মনের অসুখটাকে কি আমরা সবাই মিলে সারিয়ে তুলতে পারিনে? মনের অসুখটাও তো সাময়িক। একটা মুহূর্তের বিকার মাত্র?
হয়তো। কিন্তু এ অসুখটা যার হয় সে অসুখটাকে ভালোবাসে বলেই হয়।
নাসিমা এতক্ষণে প্রবীরের গোড়ার প্রশ্নটার উত্তর খুঁজে পায়।
আপনি বলছিলেন না, মনের অসুখ হলে তবে ঘৃণা করব কেন? প্রবীরবাবু, আপনি কখনো কাউকে ভালোবেসেছেন?
না।
ভালোবাসেন নি?
নাসিমা আবার প্রশ্ন করে। করেই প্রবীরের চোখের দিকে তাকিয়ে সঙ্গে সঙ্গে যোগ করে, —-ভালোবাসার দরকার হয় না, এমনিতেই বুঝতে পারা যায় মনের অসুখ আর শরীরের অসুখ এক নয়, প্রবীরবাবু।
বলতে বলতে কণ্ঠস্বর কখন ভাবনায় রূপান্তরিত হয়ে যায় তার। শরীরের এমন একটা নিয়ম আছে ওষুধ তাকে মানতেই হবে, যদি জীবনীশক্তি ব্যয়িত হতে হতে তার শেষ লগ্নে তখনো পৌঁছে থাকে। কিন্তু মন? মনের ভেতরে চলেছে নিয়ত নিয়মের এক দ্বিমুখী সংগ্রাম। সেখান থেকে কি মুক্তি আছে কারো? আমার মনের যে শুদ্ধ নিয়ম তাকে দিয়ে সৃষ্টি করি বাইরের পৃথিবীকে, আর আরেক দিকে বাইরের পৃথিবী তার নিয়ম দিয়ে শাসন করতে চায় আমাকে। বার থেকে এমন কোনো শক্তি নেই মনের অসুখ সারিয়ে তোলে। আত্মাকে দৃঢ় করতে পারলে আর ভয় নেই। এই দ্বিমুখী সংগ্রামের শেষ হবে কবে? কবে আমি পারবো থুতু আর কাদাকে ভয় নয়, উপেক্ষা করতে, প্রবীর?
অনেকক্ষণ কথা বলেনি নাসিমা। হঠাৎ সেটা লক্ষ্য করে সে বলল, সহজ, শাদা একটা মানুষ আজ অবধি আমার চোখে পড়ল না।
আমরা সবাই কত একা।
প্রবীর তাকাল তার চোখের দিকে।
বাইরে বৃষ্টি ধরে গেছে। আর কোনো শব্দ নেই বৃষ্টিপতনের।
প্ৰবীর বলল, আরো বসবেন, না বেরুবেন?
চলুন বেরোই। বৃষ্টির পরে শহর খুব উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, না?
নাসিমা উঠবার আগেই দাঁড়িয়ে পড়ল প্রবীর। উঠতে গিয়ে এক মুহূর্তের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গেল সে। মনে হলো, প্রবীর অদৃশ্য হয়ে গেছে, বদলে সিল্কের একটা হাওয়াই শার্ট আর চকোলেট উলেন ট্রাউজার ঝুলছে তার সমুখে।
.
আরজুর আয়নাটা নগ্ন, নিষ্ঠুর।
নেয়ে আসবার পর আসল চেহারাটা যেন বেরিয়ে এসেছে শ্যাওলা ছাড়ানো পৈঠার মত। কানের দুপাশ দিয়ে লতিয়ে নেমেছে চুলের গুচ্ছ, হয়ত সেখানে খুঁজলে একটা দুটো শাদা চোখে পড়বে। আমি পুরনো হয়ে যাচ্ছি। এই পুরনো হয়ে যাওয়াটা বড় অদ্ভুত; মনে হয়, অনেক দূরে সরে গেছি পৃথিবী, পৃথিবী ছাড়িয়ে যা কিছু সমস্ত থেকে।
বত্রিশ বছরের পুরনো মুখটাকে আয়নায় নাসিমা দেখতে থাকে।
কালো—-হ্যাঁ, কালো বই কি—- কালো ছিল বলে ছোট বেলায় মা–র আফশোসের অন্ত ছিল না। বিকেল বেলায় কোলের কা; বসিয়ে, আজো মনে আছে নাসিমার, দুধের সর দিয়ে মেজে দিতেন তার মুখ। মসৃণ হয়েছে, কমনীয়তা এসেছে, কিন্তু রঙ কাটে নি। অত শত বুঝতো না নাসিমা। মায়ের দুঃখটা আবছা করে মনে থাকতো শুধু। তারপর যখন শাড়িতে সে শ্রীমতি হয়ে উঠলো তখন অনেকটা উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল তার মুখশ্রী। নিজের বর্ণ সম্পর্কে সচেতন হয়ে থাকাটা কোনদিন তার স্বভাব ছিল না। সামান্য একটু প্রসাধন, একটু সাবান–তোয়ালে তা–ই যথেষ্ট। আনিস বলত, তোমার মুখ আকাশের মত।