দুজনে এলো মার্কেটে।
বিনতা চঞ্চল দৃষ্টি করে শাড়ি দেখতে লেগে যায়। আবার চলতে থাকে। আপন মনে একশো একটা কথা কয়ে চলে নাসিমার সঙ্গে। তারপর ওদিকের গোল বাকটার কাছে এসে বলে, কিরে তুই যে কথা বলছিস না বড়।
তুই বল। আমি শুনবো বলেই তো তোকে নিয়ে এলাম।
বিনতা স্বচ্ছ একটা হাসি পাঠিয়ে দেয় বাতাসে। নাসিমা বলে, ভাবছি ফুল কিনবো। কতদিন ফুল কিনিনি।
কোল ভরে রজনীগন্ধা কিনে নাসিমা বেরিয়ে আসে। এসে রিকশা নেয়। বিনতা বলে, ফুলের জন্যে তুই চিরকাল পাগল হয়ে রইলি।
নাসিমা বুক ভরে ঘ্রাণ নেয় রজনীগন্ধার। সারাটা শরীর যেন ফেটে পড়তে চায় তার সৌরভে।
তোর হিংসে হয়, বিনতা?
আজ রাতে বিনতা অবসাদে বিভোর ঘুমোবে। নাসিমা আজ অনেক রাত অবধি বিছানায় ছটফট করবে, তারপর ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে কলকাতার বিশাল বুকে।
নাসিমা চুপ করে এইসব ভাবছিল।
বিনতার তখন সাবেকি কথা মনে পড়েছে। বিনতা শুধালো, সেই ছেলেটিকে তোর মনে আছে?
কে? কার কথা?
নাসিমা নিজেই অবাক হয়ে যায় যতটুকু সচকিত হওয়া তার উচিত ছিল এই প্রশ্নে ততটুকু সে হলো না বলে।
আনিসকে ভুলে গেছিস নাকি?
হৃদয়ের যে স্রোতোধারা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল আবার তা বইতে শুরু করল। নাসিমা উত্তর করল, ওহ্ আনিস? না, ভুলে যাবো কেন? সাপকে কেউ ভুলে যায় কখনো?
আনিস বিয়ে করেছে।
কাকে?
জানি না।
বউ দেখেছিস? কেমন, রাঙা টুকটুকে?
হয়তো। আমি দেখিনি।
নাসিমা ভাবলো, আনিস মরে গেছে। মরে গিয়ে নতুন জন্ম নিয়েছে। এই অসংখ্য মৃত্যুর বিয়োগ থেকে জীবনকে আমি কবে শুদ্ধ করে তুলবো? বিনতা বলে চলেছে, মাসখানেক আগে এসেছিল প্রবীরের সঙ্গে। বলে গেল।—-রাগ করলি নাকি? আগে জানলে বলতাম না।
নাসিমা কি অসতর্ক হয়ে পড়েছিল? জোর করে লঘু কণ্ঠে সে বলল, রাগ করবো কেন?
.
খেতে বসার আগে নাসিমা বালতি বালতি পানি ঢেলে এলো গায়ে। বিনতার ফর্সা তোয়ালে দিয়ে গা মাথা মুছলো। খোলা এলোচুল ছড়িয়ে দিল পিঠের ওপর। ভিজে ভিজে। কালো, শীতল। স্নিগ্ধতায় শ্রীমতি হয়ে উঠলো তার মন।
ঠিক তখন প্রবীরের সঙ্গে দেখা। প্রবীর বারান্দার থামে হাত রেখে হেসে বলল, অনেক দিন পরে দেখলাম। কেমন আছেন?
ভালো। আপনি?
ভালোমন্দ কিছুই বুঝতে পারি না।
বেশ তো।
নাসিমার ভালো লাগল প্রবীরকে। স্বচ্ছ, বোধগম্য। বলল, বিয়ে করে এবার বউ আনুন।
বউ? আপনাকেও বৌদির রোগে পেল নাকি? ওই ভয়ে তো বাড়ি ছেড়েছি।
তাই নাকি?
রান্নাঘর থেকে বিনতা বলল, নাসিমা একটু গল্প কর তুই। আমার মাছটা হতে যা দেরি।
সুবোধবাবু আবার এই রাতে রেরিয়েছেন রাবড়ি আনতে।
প্রবীর হঠাৎ কুয়াশা গলায় বলল, আপনাকে দেখলাম হঠাৎ। দেখে কেন যেন ভালো লাগল—- কিছু মনে করেন নি তো?
প্রীতিময় হয়ে উঠল নাসিমা।
না, না। মনে করবার কী আছে? আপনি বেশ কথা বলেন।
কতদিন থাকবেন কলকাতায়?
কী জানি।
আসামে থাকতেন, কী হলো সেখানে?
চলে এসেছি। আর যাওয়া হবে না।
বলেই গভীর চোখে তাকাল প্রবীরের দিকে।
প্রবীর থাম থেকে হাত নামিয়ে সোজা হয়ে বলল, বৌদির কাছে চলুন। আমি এসে পড়ে আজ বেচারির রান্না বাড়িয়ে দিয়েছি।
আমিও।
দুপা এগিয়ে, থেমে, পেছন ফিরে তাকাল প্রবীর। নাসিমার শরীরটা শিরশির করে উঠলো।
না প্রবীর, আনিসের কথা তুমি বোলো না।
আনিসের কথা সে বলল না। বলল, কাল রোববার। বেড়াতে যাবেন?
আশ্বস্ত হলো নাসিমা। উত্তর করল, কোথায়?
যেখানে খুশি।—-গঙ্গার পোলের দিকে অনেকদিন যাইনি। যাবেন?
মনে মনে নাসিমা উচ্চারণ করল, আমি তোমাকে বিশ্বাস করি, প্রবীর। আমার মমতার উৎস তুমি খুলে দিয়েছ। মুখে বলল, যাবো।
.
বিনতার ছেলেমেয়েরা এরই মধ্যে এত ভক্ত হয়ে উঠেছে নাসিমার যে ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল।
২. হামেদ তখন ঘুমিয়ে ছিল
হামেদ তখন ঘুমিয়ে ছিল। নাসিমা অপলক অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল তার মুখের দিকে। আমিও কি বিবর্ণ হয়েছি এমনি? ক্ষীণ নিঃশ্বাস পড়ছে হামেদের। পৃথিবীর সঙ্গে জীবনের ক্ষীণ সূত্র। তুমি আমার সহোদর। আমি বেঁচে থাকতে চাই। খাটের পাশে আস্তে আস্তে নিঃশব্দে বসল নাসিমা। আমি বেঁচে থাকতে চাই। মমতায়, প্রীতিতে, সংগ্রামে, সৌন্দর্যে আমি বেঁচে থাকতে চাই। তোমাকে বিশ্বাস করেছি আজ শিশুরাত্রিতে। অসংখ্য আরো মৃত্যুর জন্যে তুমি আমাকে আর প্রস্তুত কোরো না, প্রবীর।
হামেদের কপালে হাত রাখলো নাসিমা।
এসেছিস?
এখন তুমি কেমন আছো?
ওই রকমই। ব্যথাটা বিকেলে আর আসেনি। বোধহয় ভালো হয়ে যাবো। তারপর একটু থেমে হামেদ চোখ বুজে বলল, তোর ভাবীকে আনিয়ে নিবি?
নাসিমা এ প্রশ্নের কোনো উত্তর করলো না। তোমার মৃত্যু শুধু তোমারই। অসুস্থতা কি কেটে যাচ্ছে হামেদের? বদলে নাসিমা বলল, বিনতার সঙ্গে দেখা হলো। আর প্রবীর।
অনেকদিন দেখিনি ওদের। এলো না?
আসবে।
তুই তাহলে কলকাতায়ই থাকবি?
কলকাতা থেকে চলে গেলে আমি দম আটকে মরে যাবো। নাসিমা অস্পষ্ট হাসতে হাসতে বলল, বড় ভালো লাগল কলকাতা। আমি এখানেই থাকব। আর মনে মনে সে বলল, আমাকে বাঁচতে দাও। আজ আমি বহু দিন পরে নরক মুক্ত হয়েছি। প্রীতির আবিরে আমি এখন আচ্ছন্ন।
বিশাল কলকাতা উদার একটা মানুষ। তার উদ্দেশে নাসিমা সমস্ত রজনীগন্ধা সমর্পণ করে ঘুমিয়ে পড়ল।
.
বুধবার বিকেলে কলকাতায় বৃষ্টি নামলো। তখন নাসিমা আর প্রবীর চৌরঙ্গির এক রেস্তোরাঁয় বসে। আস্তে আস্তে চুপ হয়ে গেল চারদিক, কেবল বেঁচে রইলো বৃষ্টির শব্দ। প্রবীর টেবিলের ওপর দুকনুই রেখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আর নাসিমার বাঁ হাতের করতলে রাখা কপোল, ডান হাত অন্যমনস্ক খেলা করছে প্রবীরের দেশলাই নিয়ে। নাসিমা দেশলাইটা দূরে সিগারেট প্যাকেটের ওপর সাজিয়ে রাখতে রাখতে বলল, আমি আমার মত করে বাঁচতে পাবো না, এইটেই বোধহয় পৃথিবীর সবচে বড় দুঃখের, তাই না?