কেন?
একটা স্পষ্ট আশঙ্কা কালো হয়ে ওঠে নাসিমার চোখে।
কেন আবার? ওর জ্বালাতেই তো এত দুর্ভোগ। নইলে থাকতাম ঝাড়া হাত পা। এত কষ্ট করে বাবা গান শিখিয়েছিলেন, শেষ অবধি দেখতাম।
নাসিমার তবু মনে হয় বিনতা অসুখী নয়। যে বিনতা এককালে এত ভালো গান গাইত, যার গান শুনে ইউনিভার্সিটির ছেলেরা ভিড় করত এক সময়ে চারপাশে, সেই বিনতা গান ছেড়ে দিয়েছে। ছেড়ে দেয়ার খেদ যতটুকু আছে কণ্ঠে, মনে তার ছায়াটুকুও নেই।
নিঃশ্বাস ছেড়ে নাসিমা বলল, বেশ আছিস তুই।
আর তুই? চা বাগানে যেতে আমার এত শখ। নিয়ে যাবি একবার?
বলতে পারে না নাসিমা, আমি আর কোনদিন সেখানে ফিরে যাবো না, বিনতা।
বিনতা বলে, বাইরেই বসে থাকবি নাকি? চল, ভেতরে চল। আমার শেষ রেকর্ডখানা তুই বোধ হয় শুনিসনি। শুনবি চল।
নাসিমা ওর সঙ্গে উঠে আসে শোবার ঘরে। খোকা তার দিকে তাকিয়ে অনেকক্ষণ ধরে দুর্বোধ্য—- করতে থাকে। বিনতার কাঁধ লালা দিয়ে বার্নিশ করে দেয়। ভারী দুষ্টু হয়েছে তো!
কী নাম রেখেছিস ওর?
চপল।
বাপের মত হয়েছে দেখতে?
কী জানি।
চোখ আর থুতনিটা কিন্তু তোর মত।
তাই নাকি?
ঘরের ভেতরে ঢুকে নাসিমা বলে, বেশ সাজিয়েছিস তো।
কী আর এমন! একটা ভালো বাসাই পেলাম না আজ অবধি।
এটাই বা মন্দ কী।
দূর। বাসা হবে বাসার মত ছবির মত। চোখভরে দেখতে ইচ্ছে করবে। বোস চেয়ারটায়। খোকাকে একটু নিবি?
নাসিমা হঠাৎ লজ্জিত হয়ে যায়। সাপটে ধরে চপলকে কোলে নিতে গিয়ে টাল খেয়ে পড়ে।
বিনতা গ্রামোফোনে চাবি দিতে দিতে বলে, দেখিস হিসু করে না দেয়।
দিলেই বা।
চপল কোল থেকে নেমে যায়। নেমে গিয়ে মেঝেতে হামাগুড়ি দেয়। হঠাৎ ধাবিত হয় এক টুকরো কাগজের দিকে।
বিনতা কাঁটা বসাতে বসাতে কাঁধ তুলে বলে, শোন।
ভক্ত কবিরের গান।
আমার হৃদয়কে আমি তুলে ধরেছি তোমারই গানে। আমার আর কোনো সাধ নেই। স্বপ্ন নেই, আমি তোমাতেই।
মিথ্যে, সব মিথ্যে। কখন যে সে ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল বুঝতে পারে নি। বিনতার কণ্ঠস্বরে সে চোখ তুলে তাকাল। বিনতা বলছে, কেমন শুনলি, বললি না কিছু?
ভাবছি, গান ছেড়ে দিয়ে ভুল করেছিস মস্ত।
হবেও বা।
ঘরের কোণে বিনতার তানপুরো ঠেস দিয়ে রাখা। মমতা দৃষ্টিতে সেদিকে বিনতা একবার তাকাল। পরে বলল, এসে অবধি আমাকে নিয়েই পড়েছিস তুই। তোর কিছু বল।
কিছু বলার নেই, তাই।
হঠাৎ গভীর চোখে বিনতা তাকে দৃষ্টি করে। বলে, তোর কী হয়েছে বলতো? এত রোগা হয়ে গেছিস।
কই, কিছু না। চিরকাল মানুষ এক রকম থাকে নাকি। বাইরে যাস না আজকাল?
খুব কম।
চল, আমার সঙ্গে বেরুবি। দুজনে মিলে মজা করে বেড়ানো যাবে। কলকাতা এত নতুন ঠেকছে, কেউ সঙ্গে না থাকলে হয়ত পথই হারিয়ে ফেলব।
সুবোধবাবু ফিরলেন একটু পরেই। নাসিমাকে দেখে মুখর হয়ে উঠলেন। নাসিমার মনে হলো অনেকদিন পরে নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছে যেন সে। আর পেছনে পেছনে বিনতার বড় মেয়েটা আর মেজ ছেলে।
তারা যখন বেরুচ্ছিল, সুবোধবাবু বললেন, আজ আমার এখানেই খাবেন। বিনতা, তুমি ওকে ছেড়ে দিয়ো না যেন।
বিনতা মুখে ঢেউ তুলে বলে, আসবে, আসবে। আমার মাছের ঝোল ও যা ভালোবাসতো। মনে করেছ ও কি ফেলে যাবে? কি বলিস? ফেরার পথে তোর দাদা আর বৌদিকেও নিয়ে আসবো।
বৌদি তো নেই। চুঁচড়োয়। আর দাদার খুব অসুখ।
নাকি?
নিভে যায় যেন বিনতা।
সুবোধবাবু আবার বলেন, ওকে নিয়ে এসো কি। আজ প্রবীরও খেতে আসবে বলেছিল। বিনতা থমকে দাঁড়িয়ে মুখ গোল করে বলে, আজ নোটিশ না দিয়ে যে! দেখা হয়েছিল বুঝি?
বাবু যে রাজকর্ম নিয়ে থাকেন।
তোমার কাছে প্রবীরের আবার নোটিশ লাগবে নাকি?
ততক্ষণে ওরা পথে নেমে এসেছে।
প্রবীর সুবোধের ছোটভাই।
বিনতার কণ্ঠ যখন গ্রামোফোনে প্রথম কথা কয়ে উঠেছিল তখন নাসিমার মনে হয়েছিল বিনতা দুজন। একজন যার কণ্ঠ গান হয়ে উঠেছে, আরেকজন তার সমুখে দাঁড়িয়ে আছে। চিবুক নিচু করে। কোথাও তাদের মিল নেই। দুজন সম্পূর্ণ আলাদা।
আমাদেরও কি এমনি করে প্রতিটি মুহূর্তে মরে গিয়ে নতুন জন্ম নিতে হয়? একেকটা মুহূর্ত আমি পেরিয়ে আসি, আর পেছনের আমাকে মনে হয় অন্য নারী তার জীবন, তার আত্মা, তার পরিবেশ আমার নয়। আমি অনেক আমি—-এই কথা আর কেউ জানবে না। আমি যে নাসিমা নই, কোনদিন তা জানবে না বিনতা—- সুবোধবাবু, প্রবীর, কেউ না।
আমার মৃত্যু হয়েছে। আজকের যে আমি তার জন্ম হয়েছে কিছুক্ষণ আগে, কলকাতায় বিনতার বারান্দায়। আমাকে কি তৈরি হতে হবে আরো অসংখ্য মৃত্যুর জন্যে?
নাসিমা তার শীর্ণ বাহু বিনতার কাঁধে রেখে শুধালো, সুবোধবাবু তোকে খুব ভালোবাসেন, না?
তুই কি দেখলি?
অনেক ভালোবাসেন তোকে।
ছেলেমানুষের মত রক্তাভ হয়ে ওঠে বিনতার মুখ।
একেক সময় কি মনে হয় জানিস? মনে হয়, এত ভালোবাসার বদলে আমি ওকে কিছুই দিতে পারলাম না।
এটা তোর বাড়াবাড়ি।
মুখে এই কথাটা বলে নাসিমা, কিন্তু মনে মনে ভাবতে থাকে, তোমার আপনমকে দান করে আজ তুমি নিঃশেষিত, অদেয় কিছু নেই আর। তবু আরো দিতে হবে। তাই এ বেদনা?
নাসিমা মুখ ফিরিয়ে বলে, চল নিউ মার্কেটে যাই। কতদিন যাইনি।
কিছু কিনবি?
না এমনি।
চল, আমিও বেরোইনি অনেকদিন। আমার ভালো লাগছে বেশ। আমি ভাবতেই পারিনি তোকে নিয়ে এমনি বেড়াতে পাবো।