তখন একটু বাড়াবাড়ি ঠেকত আরজুর।
আজ আরজুর লতানো গাছে ফুল ধরেছে। শাদা শাদা ফুল। শাদা শাদা সুগন্ধের অস্পষ্ট কুচি। বুক ভরে ঘ্রাণ নিল নাসিমা।
মতির মা এসে বলল, একটা চেয়ার পেতে দেব আপামণি?
দে, আর ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিস।
আলো নিভিয়ে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারে ভিজে গেল বারান্দা। আর শাদা শাড়িটা ম্লান হয়ে এলো কুয়াশার মত।
মনের ভেতরে সাবেকি মেঘের যেন ঢল নেমেছে।
বসে বসে গল্প করতে ইচ্ছে করছে মতির মা–র সঙ্গে! একটা মধুর বাঙালপনা তাকে পেয়ে বসছে আস্তে আস্তে। আজ আমার নতুন জন্ম, এক মুহূর্ত আমি বাঁচবো, তারপর আবার আমি মরে যাবো।
নাসিমা আবছা গলায় বলল, মতির মা, ফুল ফুটেছে দেখেছিস? ছিঁড়ে দিবি কটা?
রাতে ফুল ছিঁড়তে বারণ যে।
থাক বারণ, তুই দিবিনে? না বাপু, ঝগড়া করতে পারিনে।
অগত্যা মতির মা–কে উঠতে হয়। একমুঠো ফুল চয়ন করে হাতে দিয়ে বলে, এই নাও।
বেশ বাস ছড়িয়েছে।
কয়েকটা ফুল ওর হাতে নিয়ে নাসিমা বলে, মাথায় পরিয়ে দে।
আর বাকিগুলো দুহাত ভরে কোলের কাছে রাখে। শরীর বেয়ে লতিয়ে উঠতে চায় ঘ্রাণ। ভীষণ প্রস্তুত মনে হয় তার নিজেকে। আমাকে তুমি তোমার দৃষ্টি দিয়ে স্পর্শ কর, আমি আজ ফলসম্ভবা। যোজন দূর থেকে তুমি আজ আমাতে সঞ্চারিত হও।
মতির মা স্তব্ধতা ভেঙে বলল, আপনার সোয়ামি নাই আপামণি?
তোর কী মনে হয়?
নাই।
থাকলে বুঝি তার কাছে হাত ধরে আজ পাঠিয়ে দিতি আমাকে?
রসিকতায় মুখর হয়ে ওঠে মতির মা। সত্যি বলছ আপামণি, নাই?
.
স্বামীর কাছ থেকে পালিয়ে বেঁচে, বিষে জর্জর মন নিয়ে সার্কাস–রো–তে এসে নাসিমা ছিল কিছুদিন। সার্কাস রো–তে থাকত তার বড় ভাই হামেদ। তখন একটা শহরের জন্যে মনটা ভীষণ রকমে উদ্গ্রীব হয়ে ছিল যে শহর হবে অনেক বড়, যেখানে থাকবে অনেক আলো, আর অনেককাল আগের পুরনো সব চেনা মানুষ। কলকাতায় তাই এক সকালে এসে হাজির হলো নাসিমা আখতার।
আসামের লাবু চা বাগান থেকে কলকাতা। শেয়ালদায় নেমে নাসিমা রক্তের ভিতর গতির একটা উন্মাদনা, শুধু কণ্ঠ আর শব্দের প্রপাত অনুভব করেছিল।
নাসিমা জানতো না হামেদ কঠিন অসুখে ভুগছে। থেকে থেকে রক্তবমি করে আর পেটে তীব্র একটা ব্যথা।
ছমাস হলো বিয়ে হয়নি এরই মধ্যে কোনো জানান না দিয়ে নাসিমাকে আসতে দেখে হামেদ বিস্মিত হয়। অসুস্থতায় কোটরাগত দুচোখ তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে প্রশ্নে, চলে এলি যে? বেড়াতে?
না। বেড়াতে আসিনি। তোমার অসুখটা বেড়েছে আমাকে জানাও নি তো?
হামেদ বিছানা থেকে আধো উঠে বসে বলে, জানিয়েছিলাম। চিঠি পৌঁছোয় নি হয়ত। কিন্তু তুই এলি কেন?
জানিয়েছিল? তাহলে সে চিঠি তাকে দেয়া হয়নি। লাবু চা বাগানের ম্যানেজার, তার স্বামী—-সে চিঠি তার হাতে দেয়নি। হঠাৎ পুরনো কথাটা মনে পড়াতে নাসিমার সারা শরীর ঘৃণায় শিহরিত হয়ে উঠলো। জিভটা অশান্ত হয়ে উঠতে চাইল—-তুমি একটা পশু
উচ্চারণ করবার জন্যে। নাসিমা মুখে বলল, ভাবী কই? দেখছিনে।
রায়টের জন্যে উঁচড়োয় পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। আর আনা হয়নি।
আর একা তুমি অসুখে এখানে মরছ?
এতক্ষণে ম্লান হাসলো হামেদ। বলল, একা কই? তাছাড়া আমার ট্রিটমেন্ট দরকার, তাই কলকাতায় পড়ে আছি।
চাকর বাকর কেউ নেই?
আছে, থাকবে না কেন? নূরুকে তুই বোধ হয় দেখে গিয়েছিলি। ও–ই আছে।
বলতে বলতে হয়ত ব্যথাটা উঠে থাকবে হামেদের। ঠোঁটের দুপাশে শক্ত একটা কুঞ্চন পড়ল এক মুহূর্তের জন্যে।
নাসিমার হাসি পেল হামেদও একা থাকতে চায়। তুমি আমার সহোদর। আজ নতুন করে তোমার সঙ্গে আমার নাড়ির যোগ হলো।
নাসিমা বিছানার পাশ থেকে উঠে আসতে আসতে বলল, এখন থেকে আমি কলকাতায় থাকব। তোমার এখানে।
.
বিকেলে বেরিয়ে নাসিমা খুঁজে খুঁজে প্রথমেই পেল বিনতাকে। বিনতা আজো তেমনি সুন্দর আছে, তেমনি গৌর, সজ্জায় তেমনি নিপুণ। একটা লাল পেড়ে মিলের শাড়ি পরেছে। মাথায় একটু সিদুরের আভাস। আর খালি পা দুখানা মেঝের সঙ্গে প্রীতিময় হয়ে আছে। সব মিলিয়ে বিনতার অপূর্ব শ্রী মুগ্ধতাকে আহরণ করল।
বিনতা তাকে দেখে খুশি হয়ে উঠলো। মোড়ায় বসে মাই দিচ্ছিল খোকাকে, কাপড় টেনে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ওমা, বেঁচে আছিস তুই?
তুই কি মনে করেছিস, মরে গেছি! তোর খোকা?
মাই টানছে দেখতে পাচ্ছিস না!
বিনতা খোকার দিকে স্নেহদৃষ্টি করে। প্রশ্ন করে, তোর বুঝি হয়নি?
না।
লাবু চা বাগানে ফেলে আসা ঘৃণা তাকে শিহরিত কবল আবার স্থলিত কণ্ঠে একটু পরে সে যোগ করল, আমি চাই না। তারপর তোর কী খবর বল।
ভালো। সব ভালোই।
গান?
আজকাল আর গাই না।
তারপর একটু হেসে খোকাকে মেঝেয় বসিয়ে বলল, গাইব কী? এই নিয়ে তিনটে হলো, এখন এরাই আমার আর্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যেন ডাক্তার শুনছে রোগীর বিবরণ এমনি একটা মনোযোগ ধরে রাখে নাসিমা। বলে, তাই বলে গান ছেড়ে দিবি?
দিলাম।
সহজ কণ্ঠে বিনতা কথাটা বলে। বলে হাসতে থাকে।
সুবোধবাবু—- সুবোধবাবু কিছু বলেন না?
সুবোধকে অনেকদিন আগে দেখেছিল নাসিমা। চেহারাটা স্পষ্ট করে মনে নেই। কেবল মনে আছে নাকের নিচে একটা কালো তিল ঢাকবার জন্যে ভদ্রলোক মোটা করে গোঁফ রাখতেন।
সেই নিয়ে বিয়ের পর বিনতার কৌতুকের অন্ত ছিল না।
বিনতা বলে, সুবোধবাবু কী বলবেন? দোষটা কি তারই নয়?