চোখ বিস্ফারিত হয়ে এলো নাসিমার। তলিয়ে গেল এঞ্জিনের গর্জন। তার হৃদপিণ্ড কে যেন ছুঁড়ে ফেলে একতাল বরফ গুঁজে দিল বুকের ভেতর। নাসিমা চিৎকার করে উঠল, বব ইজ ডেড।
ঝনঝন করে চারদিকে বেজে উঠলো সেই কণ্ঠ।
যাত্রীদের সচকিত চোখ উৎস খুঁজে বের করার আগেই ছুটে এলো হোস্টেস।
হি ইজ ডেড। আসক দেম টু স্টপ দ্য ফ্লাইট।
ববের বুকে হাত রেখে হোস্টেস ধীর কণ্ঠে উচ্চারণ করল, দ’বয় ইজ স্লিপিং।
তারপর ববকে আরো ভালো করে শুইয়ে ডান হাত তার পাজরের চাপ থেকে বের করে বুকের ওপর বিছিয়ে দিয়ে হোস্টেস সোজা হয়ে দাঁড়াল। বলল, আই অ্যাম সরি, ইউ নিড রেস্ট, মাদাম।
হ্যাঁ, আমার বিশ্রাম প্রয়োজন। আর বিস্মৃতি। কিন্তু স্মৃতি ছড়িয়ে পড়ে অন্ধকারের মত বিন্দু বিন্দু করে সমস্ত কিছু সে তার লোমশ ধূসর থাবায় তুলে নেয়।
থুতু আর কাদা। তবু তৃষ্ণা।
আমাকে ভুলে যেতে দাও। আমি বড় ক্লান্ত। জীবন নয়, মৃত্যু নয়—- আমি আর কিছুতেই বাঁচি না। আমি শুধু প্রবাহিত হতে পারি এই দীর্ঘ বাতাসের করতালি পেরিয়ে, বাসনার চতুরালিকে তুচ্ছ করে অথবা না পেরিয়ে, অথবা তুচ্ছ না করে, কেননা কিছুতেই কিছু এসে যায় না।
আরজুর সংসার আবিষ্কার করার কাজটা টিকে ছিল মাত্র একটা দিন। ওদের চলে যাওয়ার পর দিনটাই শুধু। সেই একটা দিনে দেখা হয়ে গেছে সব—- ভেতর বার, অন্তরংগ, ইতস্তত সব কিছু। এমনকি এ বাসার প্রতিটি কোণ তার চেনা হয়ে গেছে। পুরনো হয়ে গেছে। মনে হয়েছে যেন তার জন্মের পর থেকে আজ এই বত্রিশটি বছর সে কাটিয়ে দিয়েছে এখানে। অথচ একাকীত্বের প্রথম মুহূর্তটা মনে হয়েছিল হঠাৎ পাওয়া একটা গিনির মত।
আরজু তার মেয়েকে নিশ্চয়ই আদর করে মাত্রারও বেশি, নইলে এত কাপড় থাকে অতটুকু চার বছরের মেয়ের? আর এত খেলনা? কাপড়গুলো আলনায়, এখানে সেখানে স্তূপ স্তূপ হয়ে আছে পাঁচমিশোল রঙের ছোপের মত। দূর থেকে চোখে পড়ে। আর কী ঠাণ্ডা! একবার হাতে করে দেখেছিল নাসিমা। একটা গোলাপি ফ্রক এত মুড়মুড়ে সিল্কের তৈরি যে, আলতো করে হাতে তুলতেই খসখস করে পড়ে গেছে মাটিতে। আবার আরেকটা সবুজে চুমকি বসানো চাঁদের অনুকরণে। আরেকটা কাঁচের মত স্বচ্ছ আর অনুভব কাগজের মত। লাল, রক্তিমাভ, ভায়োলেট। আরো, আরো, আরো।
খেপে ওঠা দুহাতে নাসিমা সবগুলো ছুঁড়ে খুঁড়ে জড়ো করেছিল মেঝের মাঝখানে। কী সে। বিতৃষ্ণা তাকে ভর করেছিল কে জানে। কেবলি থেকে থেকে কে যেন মনের ভেতর বলছিল—-নোংরা, বিশ্রী, জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে ফ্যালো। কেন? কেন থাকবে এখানে এগুলো? কিন্তু কোথায় যে হবে তার স্থান, তাও স্পষ্ট নয় তার কাছে।
কাপড়গুলো একটার ওপর আরেকটা পড়ে যেন কিলবিল করতে থাকে নাসিমার চোখের সমুখে। তারপর কী মনে হয়, আগের চেয়েও দ্রুত দুহাতে সব গুছিয়ে রাখে আলনায়। একটা ক্লান্তি, শরীর থেকে শক্তির একটা অপচয় অনুভব করতে করতে নাসিমা পড়ে থাকে বারান্দায় আরাম চেয়ারে।
তারপর থেকে মনটা যেন মরে গেছে ওই আলনায় রাখা কাপড়গুলোর জন্যে। যেন আর চোখেই পড়তে চায় না নাসিমার।
সেদিন নাইবার জন্য প্রাণ আকুল হয়ে ওঠে। সেদিন সময়টা ছিল ভর সন্ধ্যে। মনের অরণ্যে যে বিরাট গাছ তার সহস্র শেকড় প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে আছে সেখানে হোঁচট খেলে তার তৃক শিরশির করে ওঠে। তখন নাইতে হয়! ঠাণ্ডা পানির ধারায় নিজেকে শীতল করে তুলতে হয়। এক সময়ে যখন আর কোনো স্পর্শের বোধ থাকে না তখন সে উঠে আসে।
সেদিন নেয়ে এসে নিজের কাপড় বাছতে বসলো। কোনটাই টানলো না তাকে। তখন উঠে এলো আরজুর ওয়ার্ডরোবের কাছে। বেছে বেছে বার করল মাখনের মত নয়োম, মুঠো করলে এতটুকু, দুধ শাদা, পাড়ছাড়া একটা শাড়ি। মনটা যে হঠাৎ শুদ্ধ সুন্দর হয়ে উঠেছে, তার প্রতীক করে পরলো শাড়িখানা। কোমল ভেলভেটের লাল চটি দিল পায়ে। বাতাসের মত লঘু গতিতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল নাসিমা।
আহ, কী সুন্দর ফুল ফুটেছে আজ ওই লতানো গাছটায়! আরজুর যে ফুলের শখ তা কি জানতো নাসিমা? হয়ত এই তিন বছরের অসাক্ষাতের ব্যবধানে এই শখটা হয়েছে আরজুর। মনে আছে সেই তারা যখন কলকাতায় পড়ত কলেজে, কী এলোমেলো কাঠ–কাঠ ছিল মেয়েটা। প্রথম দিন এসে হস্টেলের ডরমিটরিতে থাকতে হয়েছিল আরজুকে। চাদরটা ময়লা ছিল ওর, নাসিমা তার নিজের ফুলতোলা চাদর ট্রাঙ্ক থেকে বের করে দিয়েছিল। সেইদিন থেকে ভাব। আরজু বলেছিল চোখ গোল করে, এত বড় ফুল চাদরে? কে করেছে?
কে আবার? আমি করেছি।
কথাটা মিথ্যে। বউবাজার থেকে শখ করে কিনেছিল সে একদিন।
ততক্ষণে আরজু শুয়ে পড়েছে বিছানায়। নাসিমা শুধিয়েছিল চোখে কৌতুক নাচিয়ে, কী, পিঠে ফুটছে?
উঁহু।
ফুটলোই বা। ফুল তো। তোমার ফুল ভালো লাগে না?
না।
সত্যি মেয়েটার সখ বলতে কিছু ছিল না তখন। ফুটপাথ থেকে কতদিন রিকশা থামিয়ে নাসিমা কোলভরে ফুল কিনে এনেছে। তার থেকে কয়েকটা স্তবক হয়ত শোভা পেয়েছে আবজুর শিথানে, কিন্তু সে নিজে কোনদিন সাগ্রহ হয়নি ফুলের জন্যে। বরং নাসিমা যখন বলত, একদিন ফুল না হলে, জানিস আরজু, মনে হয় কী একটা যেন হারিয়ে ফেলেছি। ভিতরটা কেমন হাহাকার করতে থাকে সব সময়। লোকে মদ খায়, রেস খেলে, আর আমার নেশা ফুল।