জওয়াদ চকিতে নিজের দিকে তাকিয়ে দ্রুত কিন্তু সংক্ষিপ্ত হেসে উঠেছে। আজ কয়েকদিন হলো জওয়াদের হাসিগুলো এমনি সংক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে কেন যেন। বদলে নাসিমা কিন্তু হাসলো তার সারা শরীরে ঝিলমিল তুলে।
তারপর সিঁড়ি দিয়ে পাশাপাশি নামতে গিয়ে ওই দুর্ঘটনা।
জ্ঞান যখন ফিরলো তখন বুকের ওপর ঝুঁকে পড়া ডাক্তারের মুখ দেখে চিৎকার করে উঠতে চেয়েছিল নাসিমা। মুখটা প্রথমে মনে হয়েছিল পাথরের ওজনের মত—- নত হয়ে আছে। বিপজ্জনক রকমে সূক্ষ্ম একটা সুতো থেকে। ডাক্তার তখন ডান হাত শূন্যে হাওয়ায় তুলে বলল, ডোন্ট রাইজ, মাদাম।
সেই হাতটা দৃষ্টি দিয়ে অনুসরণ করতে করতে ফিসফিস করে তখন সে উচ্চারণ করেছে, হোয়াই আই অ্যাম হিয়ার, ডক্টর?
ইউ ওয়ার ইল। ইটস অলরাইট নাউ। প্লিজ ডোন্ট টক। ইওর হাজব্যান্ড উইল কাম ইন দ ইভনিং।
আশ্চর্য রকমে কান্নার উৎস আজ তার শুকিয়ে গেছে। মথিত একটি মুহূর্ত অতিক্রম করে রুক্ষ কর্কশ, ফিসফিস কণ্ঠে সে বলল, আই নো ইটস নট অলরাইট, ডক্। ইউ কুড নট সেভ মাই বেবি।
.
জওয়াদ সেদিন বিকেলে আসেনি। এসেছে পরদিন। কিংবা কবে এসেছে তা আজ মনে পড়ে
নাসিমার। শুধু মনে পড়ে রাত্রে •ার্সের দেয়া দুধ মুখে দিয়ে হঠাৎ বিবমিষায় দুচোখে আঁধার দেখতে দেখতে তার আত্মা থেকে এক চিৎকার উঠেছে। তুমি কেন এমন করলে? তুমি কি ভয় পেয়েছিলে আমি তোমাকে নিষ্ঠুর একটা বিপদে ফেলব? তাই কি তোমার মুখোশ ছিল আমাকে ধরে রাখতে? তোমাকে আমি বিশ্বাস করতে চেয়েছিলাম।
নাসিমাকে সিঁড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল জওয়াদ।
.
রাতে নাসিমা উঠে এসে জওয়াদের কামরায় ঢুকলো। জওয়াদ ঘুমিয়ে আছে।
হঠাৎ হাসি পেল নাসিমার ঘুমোনো এই মানুষটার দিকে তাকিয়ে। ঘুমোলে এত অসহায়, এত উদ্যমহীন মনে হয় মানুষকে?
দৃষ্টি থেকে শেষ দ্বীপটি নিমগ্ন হয়ে গেলে থাকে শুধু মৃত্যুর মত বিশাল দিগন্ত। তখন যেদিকেই তুমি যাও, একই। কোনো প্রেক্ষিত নেই, ধ্রুব নেই—- আছে শুধু হওয়া এবং না—- হওয়ার ভয়াবহ মধ্যবিন্দু। হাসলো না নাসিমা আখতার। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল শুধু। এমন কি জওয়াদকেও সে যেন আর দেখছে না দেখতে পাচ্ছে না। আস্তে আস্তে কেমন অবাস্তব, অস্তিত্বহীন হয়ে আসছে সবকিছু। পেছনে সরে যাচ্ছে। জওয়াদ হঠাৎ চোখ মেলে তাকিয়ে চমকে উঠল ভূগ্রস্তের মত। কী ভীষণ দৃষ্টি তাকে বিদ্ধ করছে!
লাফ দিয়ে উঠে নাসিমার বাহুমূল ধরে ঝাঁকি দিয়ে সে বলল, নাসিমা নাসিমা।
নাসিমা তখনো তেমনি তাকিয়ে আছে। যেন এই স্পর্শ জড়িয়ে আছে কোনো পাথরের গায়ে। তখন ভয় পেল জওয়াদ। ভীষণ একটা ভয়ে তার মুঠো শিথিল হয়ে এলো। ঠিক সেই দম আটকানো মুহূর্তে নাসিমা স্বপ্নের মত উচ্চারণে বলল, ইউ আর অ্যাফ্রেড, লিটল বয়।
জওয়াদ হাত নামিয়ে নিল। মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ল, হোয়াট!
নাসিমা তখন ছেলেমানুষের মত দুহাত নাভিমূলের কাছে মুঠো করে ধরে শরীরটাকে সি সর মত দোলাতে দোলাতে বলল, মাই মাদার কেম টু মি টু নাইট। শি সে আই মাস্ট নট প্লে ইন দ সান। ইট ইজ সামার দেয়ার হঠাৎ প্রসঙ্গ বদলে
—-এভার সিন এ স্লিপিং টপ? মাই বিগ ব্রাদার ক্যান ডু দ্যাট। আই কান্ট। ক্যান ইউ? বাট ইউ আর অ্যাফ্রেড টু নাইট হাউ ক্যান ইউ।
নাসিমা খিলখিল করে হেসে উঠে হঠাৎ ভাবনায় ডুবে গেল। মাথাটা একটু বাঁকিয়ে দৃষ্টি দূরে সরিয়ে, অনেক সুদূরে, কী যেন ভাবতে লাগল।
হোয়াটস দিস ফান?
ইয়েস, বুলি মি—- ইয়েস, গো অন।
জওয়াদ এতক্ষণে তার চোখের তারা থেকে কী যেন আবিষ্কার করতে পারে। দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করতে চায়, ইউ আর নট হিউম্যান।
বলতে পারে না। আমতা আমতা করতে থাকে। এক পা পিছিয়ে দাঁড়ায়। ভয় করতে থাকে, এ কার সঙ্গে এতকাল সে কাটিয়েছে? আজ নতুন করে যেন তাকে চিনতে পারল। ঠিক চিনতে পারল না, যাকে সে এতকাল চিনত সে বদলে গিয়ে এখন এমন একটা মানুষের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে যাকে সে কোনো দিনই দেখেনি। হঠাৎ নাসিমার মনে হলো লোকটা কালো ভীষণ ভয়াবহ কালো হয়ে যাচ্ছে
লুক হি ইজ অ্যাফ্রেড। নো নো নো।
চিৎকার করে জওয়াদের পায়ের কাছে মূৰ্ছিত হয়ে পড়ে গেল নাসিমা আখতারের থরথর করে কেঁপে ওঠা শরীর।
.
বেবির হাতের উষ্ণতায় নিজের করতল উত্তাপে রক্তিম করে তুলতে চায় নাসিমা। একজিবিশনে মেরি গো রাউন্ডের দ্রুতচক্র আলোর বিক্ষিপ্ততায় দাঁড়িয়ে নাসিমা আখতার বেবির দিকে তাকিয়ে বলে, আজ রাতে তুই আমার ওখানে থাকবি। কেমন?
লক্ষ্মীবাজার, ঢাকা
১৯৫৯