না, মণিখালা, কানে আঙ্গুল দিয়ো না। আমি জওয়াদকে ভালোবাসি না, ওর মনে যদিও বা কখনো জন্ম নিতে চায় ভালোবাসা আমি তাকে নিষ্ঠুর হাতে দাবিয়ে দি। কেননা ওটাকে বাড়তে দিয়ে নিজে কষ্ট পেতে চাই না।
আরো আমার সুবিধে জওয়াদ–এর মাতৃভাষা সিন্ধি, ওর অনেক কথাই আমি বুঝতে পারব না। মনের কথাগুলোকে তাই আমার জন্যেও কখনোই ফেনিয়ে তুলে প্রকাশ করতে পারে না।
আমার সন্তানকে, যদি সে কোনদিন আসে, আমি ভালোবাসতে পারব এই আশা নিয়ে আছি। মিথ্যে প্রেমের মুখোশের জন্য আমার আর কোনো বাসনা নেই।
তোমাদের আমি কিছুতেই বোঝাতে পারব না, আমি কোনো পাপ করছি না। তাছাড়া বোঝানোর মত মনের দীপ্তিও এখন আমার নেই। জওয়াদ এর চেয়ে বেশি কিছু আমার কাছে চায়নি। অত্যন্ত সহজ, সরাসরি ছিল ওর প্রার্থনা। খুশি হয়েছিলাম আমাকে তা–ই নিযে থাকতে দাও। অনেক ভেবে দেখেছি মন আব শরীর, দুটোকে এক করে দেখলেই যত বিপত্তি—-যা আর দশজন দেখে থাকে। বিপত্তির সম্ভাবনা এখানে নেই বলেই জওয়াদকে নিয়ে আমি তোমাদের মুখোমুখি এত নির্ভীক।
আমাকে ভুলে গেলেই ভালো। আমার জন্য কাউকে ভাবতে হবে না। ইতি তোমাদের, নাসিমা।
বেরিয়ে এলো নাসিমা। ঘরে ফিরে দেখল জওয়াদ তখনো আসে নি।
নাসিমা খেয়ে নিয়ে নিজের কামরায় গিয়ে পড়তে বসলো কালকে যা পড়াতে হবে। জওয়াদ ফিরে এলো, টের পেল তাও। ফিরে এসে কোনদিন তাকে সে বিরক্ত করে না।
আজ জওয়াদ দরোজায় নক করলো।
আসতে পারি?
কাজ করছি।
প্লিজ।
এসো, এক মিনিটের বেশি বসতে পাবে না কিন্তু।
জওয়াদ এসে দাঁড়াল ঘরের মাঝখানে। জওয়াদের ভঙ্গিটাই অমনি। কাছে এসে ঝুঁকে পড়ে বলল, নিঃশ্বাসের উষ্ণতা তার কাঁধের ওপর ছড়িয়ে, আসবে?
না।
জওয়াদ দ্বিতীয়বার আর অনুরোধ করে না। শুধু বলে, মে আই কিস? প্লিজ, জাস্ট এ পেক ডিয়ার।
অলরাইট।
গালের ওপর ঠোঁট চুঁইয়ে জওয়াদ উঠে দাঁড়ায়। বলে, সাম টাইম আই থিঙ্ক আই অ্যাম ইন লাভ উইথ ইউ।
শ–স্–স্। ডোন্ট লাই। নাউ গো ব্যাক, রাইট আউট অফ মাই ডোর।
জওয়াদ চলে যায়। জওয়াদ তাকে বিরক্ত করে না, এর জন্য সে অনেক কৃতজ্ঞ। জওয়াদকে তার সহোদরের মত মনে হয়।
সন্তান সম্ভাবনার কথা জওয়াদ জানতে পেরে অবধি কেমন গম্ভীর হয়ে গেছে। ভালো করে। তাকাতে পারে না নাসিমার দিকে। নাসিমা মনে মনে কষ্ট পায়, কী হলো তোমার? মনে মনে স্থির করে তখন, জওয়াদকে ছেড়ে সে চলে যাবে। লোকটা যদি বিব্রত হয়ে থাকে, তাকে মুক্তি দেয়াই ভালো। মনে রাখব তাকে, আমার সন্তানের জন্য তার ওপর আমি নির্ভর করেছিলাম। ও যা নেবার নিয়েছে, আমার যা পাওয়ার পেয়েছি। আর কোনো সম্পর্ক না থাকাই ভালো।
চলে যাওয়ার কথাটা স্পষ্ট করে নাসিমা বলার আগেই জওয়াদ বুঝতে পেরেছিল। ক্ষুব্ধ একটা মুখভঙ্গি করে বলেছিল, জানি না কী তোমার হয়েছে। একেক সময় আমার মনে হয় তোমাকে আমার বড় প্রয়োজন। কোনদিন তুমি জানতে চাইলে না আমি তোমাকে ভালবেসেছি কিনা
প্রয়োজন এই শব্দটা তখন বড় সুদূর মনে হয়েছিল নাসিমার, এমন কি এর অর্থটাও যেন তার কাছে স্পষ্ট নয়। আর আরাম চেয়ারে শরীর এলিয়ে দূরে দরোজার কাছে দাঁড়ানো জওয়াদের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল অন্য কোনো মানুষের জন্য এই মানুষটার অনুভূতি সে শুনছে এক পরম আলস্যে। জওয়াদ বলে চলেছে,
—-আমাকে ছেড়ে যেও না। প্লিজ স্টে উইথ মি।
তখন আরো কষ্ট হয়েছিলো লোকটার জন্যে। অনেকদিন পরে নিবিড় করে কারো জন্যে কষ্ট হলো তার। আর সেই কষ্টটা কেমন ছায়া ছায়া, সচকিত।
আজ তার এই আসন্ন পূর্ণতার মুহূর্তে পৃথিবীর কোনো কোণে সামান্যতম কোন বেদনাও অসহনীয়। বলল, অলরাইট। ইফ ইউ ওয়ান্ট মি টু স্টে, আই উইল। ইউ মেড মি ব্রিদ এগেন, আই উড নেভার মেক ইউ আনহ্যাপি। ইয়েস আই উইল স্টে।
কৃতজ্ঞতায় শ্রদ্ধায় যে আমার মন আকণ্ঠ ভরে উঠেছে, জওয়াদ। কোনদিন তুমি জানতে চাওনি, জানবেও না, কেন আমি তোমার ক্ষুধার হাতে একদিন নিজেকে তুলে দিয়েছিলাম। আমার তৃষ্ণার রূপ তুমি কোনদিন বুঝতে পারবে না হয়ত।
আমি তোমাকে আর কাছে আসতে দেব না, দূর থেকে তুমি আমার প্রীতিভাজন হয়ে থাকবে।
জওয়াদ, আমাকে এখন একটু একা থাকতে দাও।
.
কিন্তু স্মৃতি একটা পশুর মত ছড়িয়ে পড়ে নিঃশব্দে, পায়ে পায়ে—-আলোতে, অন্ধকারে, পৃথিবীতে, পৃথিবীর অন্তিমে কোটি কোটি শূন্যতায়।
পৃথিবীতে মানবজন্মের পাওনা কি শুধু থুতু আর কাদা? আঘাতের পর আঘাত নাসিমাকে অদ্ভুত রকমে বিজ্ঞ করে দিয়ে গেছে।
.
সব উঁচু সিঁড়ি থেকে নিচে গড়িয়ে পড়তে পড়তে দুঃস্বপ্নের মত নাসিমার চোখে নেমে এলো জওয়াদের এই কদিন পালিয়ে বেড়ানো, যমকালো মুখ আর কপালের ত্রিশূল। মুখটা অস্পষ্ট হতে হতে অন্ধকার হয়ে গেল। শৈবালের মত থোকা থোকা অন্ধকারে ঢেকে গেল তার সমস্ত চেতনা।
বিকেলে নাসিমাকে জওয়াদ বলেছিল, কতদিন তোমার সঙ্গে বেরোইনি আজ বেরুবে?
এই সামান্য প্রশ্রয় দেয়ার লোভটুকু সে সামলাতে পারেনি। বলেছে, তুমি যদি চাও, বেশতো।
তারপর সেরে নিয়েছে স্বল্পপ্রসাধন। মাতৃত্বের বীজে ফুলে উঠেছে সে। অনেকক্ষণ ধরে শাড়িটা ঠিকমত পরে নিয়ে বলেছে, চল আমি তৈরি।
তারপর একটু ঠাট্টা করবার আগ্রহে কপট কণ্ঠে—- হোয়াই! ইউ লুক লাইক এ নটি বয়, ডিয়ার। ইউ শুড হ্যাভ কম্বড ইওর হেয়ার ডিসেন্টলি অ্যান্ড ইন দোজ ব্যাগি প্যান্টস! হেভেনস্!