জুতো কেনবার পর ফুটপাথে দাঁড়িয়ে বেবি হাতঘড়ি দেখে বলল, রাত স’আটটা বাজে।
তা কী করবি এখন, যাবি?
সারাদিন তো বাইরে।
নাসিমা গলায় জোর এনে একটু দ্বিধার পর উচ্চারণ করে, থাক, যাবিনে এখন। পায়ে লাগছে?
জুতোর দিকে তাকিয়ে নাসিমা শুধোয়।
নাহ। বেশ হয়েছে।
কাল তোর চোখ দেখেই বুঝেছিলাম, পছন্দ করেছিস। আমাকে বলিসনি কেন? বললেই হতো।
তারপর একটু থেমে বেবির দিকে তাকিয়ে মাথা কাত করে বলে, চল একজিবিশনে যাই, যাবি?
সে তো কাল যাবে বলেছিলে।
নাসিমা যেন নিভে গেল।
আজ যাবি না তাহলে?
এই জুতো হাতে নিয়ে?
বেবি আবছা কৌতুকে স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। হঠাৎ তার কী মনে হয়, কী একটা নামহীন কষ্ট হয়, বলে, দাঁড়াও দোকানে রেখে যাই। কাল এসে নিয়ে যাবো।
রিকশায় উঠে বসে ওরা। বেবি সিগারেট ধরায়। হুড তোলা আবরণে ওর অন্ধকার মুখ সিগারেটের লাল আগুনে থেকে থেকে জ্বলে ওঠে। মনে হয় জ্বলন্ত তার মুখ।
হাইকোর্টের মোড়ে বিশাল গাছগুলোর অন্ধকারে যখন তারা তখন নাসিমা হাত রাখলো
বেবির পিঠে। বেবি বহুক্ষণ পরে একটা স্বস্তি অনুভব করলো। কী উষ্ণ, চেনা চেনা আর নিবিড় তার হাত। কোন কথা বলল না সে। নাসিমা একটু পর বলল, বেবি, আমার কাছে তুই লুকোবি নে বল।
কী?
ওরা কী বলেছিল?
বলেছিল—-দূর, আমি বলতে পারবো না।
তুই কিছু বলেছিস?
না। কী বলব?
নাসিমা তখন একটা নিঃশ্বাস লুকোলো। অপসৃয়মাণ অন্ধকার আর দূরে দূরে বিজলি আলোর বৃত্তের দিকে তাকিয়ে ভাবল খানিক। তারপর খুব আবছা গলায় বলল, বেবি, মানুষকে আমি চিনি। ওদের স্বভাব শুধু আঘাত করা, আঘাতটাকে উপেক্ষা করতে পারলেই হলো। আর কিছু না। নিজের কাছে যেটা জরুরি মনে হয়, সেইটাই বড়। মানুষ আমাকে কম আঘাত দেয়নি, বেবি। লোকের দেখাটাকে বড় করে দেখলে ঠকতে হয়, নিজের কাছে অপরাধী হতে হয়—- পৃথিবীতে পাপ শুধু এইটেই।
বেবি চুপ করে শোনে। নাসিমা তার নিজেরই উচ্চারণকে বিশ্বাস করবার জন্যে মনে মনে আকুল হয়ে ওঠে।
পালানো, শুধু পালানো। আমার শক্তি নেই তাই বারবার আমি পালিয়ে আসি। মানুষের নিষ্ঠুরতাকে আমি ভয় পাই।
একবার আমি মেরুদণ্ড পেয়েছিলাম—- করাচিতে। কিন্তু মানুষ কত নির্ভরশীল। একটা আনন্দ, কিংবা বেদনা, এমনকি এই শরীরটার জন্যে প্রথমত আমরা জনক–জননীর ওপর নির্ভরশীল। এই দুঃসহ বন্ধনসূত্রকে কেউ কোনদিন এড়াতে পারবে না। নির্ভর করতে হয়েছিল আমাকেও, কিন্তু যার ওপরে আমি সেদিন নির্ভর করেছিলাম সে বঞ্চনা করলো। আমার সে মেরুদণ্ড মোমের মত নত হয়ে এলো সেই বঞ্চনার পর। আমাকে রিক্ত করে দিয়ে গেল।
বেবিকেও হারাতে হবে? শুধু আমি নই, তোমাকেও যে উপেক্ষা করতে হবে—-পারবে না তুমি? নাসিমা স্পর্শ দিয়ে ওকে উপলব্ধি করতে চায়। তার অসীম রিক্ততা প্রাচীন জাহাজের বিশাল পালের মত ফুলে ফুলে উঠতে থাকে তখন। প্রতীক চিহ্নের মত স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে সেই ধূসর থাবা। আছড়ায়। ফেটে পড়বার শক্তিটুকু যেন তার অন্তর্হিত হয়ে গেছে। শুকিয়ে গেছে রক্তের নদী। অতলে, আরো অতলে, নাসিমা। ক্লান্তির কালো চোখের আরো পেছনে।
.
অনেকক্ষণ ধরে ক্লিফটনের বালুতে পা ডুবিয়ে বসে থাকে নাসিমা আখতার। হাতের মুঠোয় দলা পাকানো মণিখালার চিঠি। চিঠিটার কথা এখন আর সে ভাবছে না মোটেই।
এক কাপ কাফির তৃষ্ণায় মন উতলা হয়ে ওঠে। ঘরে ফিরে গেলে নিজে বানিয়ে খাওয়া যেত দুপা সমুখে ছড়িয়ে গান শুনতে শুনতে। কিন্তু এত শীগগীর সে ফিরবে না। ফেরে না কোনদিনই। বরং জওয়াদের কাছ থেকে যতটা দূরে থাকা যায়, ভালো। জীবিকার জন্যে যে চাকরি করা তার, দিনের মেয়াদ শেষ হলে নাসিমা ব্যস্ত হয়ে পড়ে গোটা শহরটা নিয়ে। কোনদিন দোকানে দোকানে শো কেস দেখে কাটায় আবার কোনদিন সমুদ্রসৈকতে মানুষ, একেক দিন আবার উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়ায় এ পাড়া থেকে সে পাড়া। জড়িয়ে পরবার ভয়। নেই, হোঁচট খাবার সম্ভাবনা নেই, এতে পাওয়ার বিনিময়ে দিতে হয় না কিছুই। অনেক বড় শহরে হারিয়ে যাওয়ার এই নেশা নাসিমার আজো কাটেনি।
বরং রেস্তোরাঁয় যাওয়া যাক। নাসিমা আখতার উঠে দাঁড়ায়।
রেস্তোরাঁয় বসে বসে মণিখালার চিঠির একটা উত্তর মনে মনে দাঁড় করায়। সেটা খানিকটা এমনি
আমি যখন পড়ানোর এই কাজটা নিয়ে করাচি আসি, তখনো তোমার মত নিইনি—-চাটগাঁয়। গিয়েছিলাম সেও আমার নিজেরই ইচ্ছেয়। তুমি যদি আরো বিশদ করে আমাকে জানতে মণিখালা, তাহলে বুঝতে পারতে, আমি আমার ইচ্ছেটাকে কতখানি শ্রদ্ধা করি। এ সব কথা। বলার উদ্দেশ্য তোমাকে আঘাত করা নয়, তুমি যা জানতে চেয়েছ এ তারই উত্তর।
তোমরা ঠিকই শুনেছ জওয়াদের সঙ্গে আমি আজ কয়েক মাস হলো থাকছি। আমাদের বিয়ে হয়নি। শুনে হয়ত অবাক হবে, বিয়ে হবেও না। আমি ওকে ভালোবাসি না। তবু আছি। শুনে হয়ত আহত হবে, আমাকে ঘৃণা করবে, কিন্তু আমি জানি আমি কী করছি।
তুমি হয়ত প্রশ্ন করবে, তাহলে জওয়াদের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা কী রকম? আমি যদি এর কোনো নাম দিই তোমরা বলবে বড় বড় কথা দিয়ে কুৎসিত ব্যাপারটাকে ঢাকছি তাই কোনো নাম দেব না। প্রেম মিথ্যে, মণিখালা যাকে আমি প্রেম বলে থাকি।
অনেক তো দেখলাম, নিজেকে নামিয়ে নিতে পারলাম না কিছুতেই। কিন্তু শেষ অবধি আমি তো আমার কাছে সত্যি?