নাসিমা আখতার আবিষ্কার করে এই বিরাট ধাতব পাখির প্রাণ–যন্ত্রের সঙ্গে তার হৃদস্পন্দন এখন এক, অবিচ্ছেদ্য হয়ে গেছে। এ এক অদ্ভুত আত্মীয়তা, এর কোনো ইতিহাস নেই, আজই যেন প্রথম প্রতিষ্ঠিত হলো এই আত্মীয়তার সূত্র। চলছে, এগিয়ে চলছে। হ্রদে ঢেউয়ের মত চলছে তারা। সমস্ত যান জুড়ে কাঁপছে একটা মৃদু তরঙ্গ। আর তেমনি তরঙ্গ কাঁপন তুলছে আমার চেতনায়। এখন, এই মুহূর্তে, যদি সে থেমে যায় তাহলে নির্বাপিত হবো আমিও। আমি বিশ্বাস দিয়েছি এই আকাশযানকে।
কিন্তু দিয়েছে কি সবাই? প্রতিটি যাত্রী? সুখী মসৃণ মানুষের ভিড়। নাসিমা দৃষ্টি করে এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অবধি, যেখানে মুঠোর মত প্যাসেজটা সরু হয়ে এসেছে।
নাসিমার মনে হলো একপাল ভিন্ জাতের প্রাণীদের ভেতরে কেউ তাকে জোর করে পুরে দিয়ে দরোজা দিয়েছে সেঁটে।
একমাত্র পাশের ছেলেটা কী সূত্রে তার মনের কাছে আপন হয়ে উঠেছে তা সে নিজেই জানে না। ছেলেটা তখন জানালা দিয়ে অপসৃয়মাণ নিচের পৃথিবীকে তাকিয়ে দেখছে টফি খেতে খেতে। নাসিমার মনে হলো পৃথিবীর সুন্দরতম একটা ড্রয়িং ঈশ্বর ধরে রেখেছেন। পাশ দিয়ে হোস্টোস যাচ্ছিল। নাসিমা তাকে ডাকলো। পলকে সুন্দর মুখখানা ফিরিয়ে স্বচ্ছ গলায় শুধালো একটু ঝুঁকে পড়ে, ইয়েস মাদাম। নিড এনি হেল্প।
নাসিমা তাকে আদৌ ডেকেছিল কি? আর যদি ডেকেই থাকে, তাহলে হয়ত সে শুধোতে চেয়েছিল, সে ভাবলো—-যদি প্লেনটা হঠাৎ জ্বলে ওঠে, আগুন ধরে যায়, তাহলে তাহলে কী হবে হোস্টেস?
তাহলে তুমি মুক্তি পেয়ে যাবে এই অসীম মনে রাখার দায় থেকে, আর পাথরের মত এক মুহূর্তে জমে কঠিন হয়ে যাবে রক্তঝরার অদৃশ্য সেই উৎস।
মনের ভাবনাটা কখন কথা হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে নাসিমা বুঝতে পারেনি। বিস্ফারিত চোখে সে শুধু দেখল, সে হোস্টেসের দুই বাহুমূল শক্ত মুঠোয় ধরে আছে। আর সেই সবুজবসনা নত হয়ে আস্তে আস্তে তার পায়ের কাছে বসে শুধোচ্ছে, ডিড ইউ সে সামথিং মাদাম?
নো নো আই হ্যাভন।
নাসিমার ঠোঁট কাঁপতে থাকে। একটু পরে বলে, আই নিড স্লিপিং ট্যাবলেটস—-দ্যাটস অল। ক্যান ইউ গেট মি সাম?
ইয়েস, অফকোর্স।
পায়ের তলায় পৃথিবীর একশো আশি ডিগ্রী ব্যাপ্তি কেবলি পেছনে সরে যাচ্ছে। আর আমার ফুসফুঁসে যন্ত্রের বানানো বাতাস। ধাতব পাখির যে অবিরাম গর্জন ছিল যাত্রার শুরু থেকে তার সহচর, একটু আগে তা কোন জাদু বলে যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। হোস্টেস চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই গর্জনটা যেন দ্বিগুণ হয়ে চিতাবাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল নাসিমার শ্রুতিতে।
পাশ থেকে ছেলেটা হঠাৎ শুধালো বাদামি চোখ চঞ্চল করে, আর ইউ স্কেয়ার্ড?
হাসলো নাসিমা। হাসির রেখা তার মুখাবয়বকে নতুন করল।
নো, আই অ্যাম নট, ডার্লিং।
বাট শি সেড—-ছেলেটা মুখ ঘুরিয়ে স্লিপিং ট্যাবলেট নিয়ে আগতা হোস্টেসকে ইঙ্গিত করল—-ইউ আর।
নাসিমা ধন্যবাদ জানিয়ে ট্যাবলেট আর পানি নিল হোস্টেসের হাত থেকে। তারপর হোস্টেস চলে গেলে ফিসফিস করে বলল, শি লাইজ।
ছেলেটা কৌতুকে হেসে উঠলো। নাসিমা শুধালো, বাট ইউ আর নট স্কেয়ার্ড।
হঠাৎ একটা দায়িত্ব ফুটে উঠলো ছেলেটার কণ্ঠে, নো। মাই আঙ্কল সে আই অ্যাম এ ব্রেভ বয়।
বাট ইউ আর, ডার্লিং।
তাহলে লোকটা ওর চাচা, কিংবা মামা, কিংবা ফুফাও হতে পারে। আস্তে আস্তে কথা জমে উঠলো ছেলেটার সঙ্গে নাসিমার। ডাক নাম—- বব, ভালো নাম আসাদ রেজা চৌধুরী। ববের বাবা ঢাকার নামকরা ব্যারিস্টার। সেই ইনে থাকবার সময় বিয়ে করে এনেছিলেন বিদেশিনীকে। কিন্তু দেশে ফেরার বছরখানেকের মধ্যেই প্রকট হয়ে উঠল একটা ফাটল–চিহ্ন দিনে দিনে। লন্ডনে ফিরে গেল ববের মা দুবছরের ববকে নিয়ে। বিদেশিনী এবার বিয়ে করলো তার স্বদেশেই। আট বছর বয়সে বব এলে করাচিতে আঙ্কলের কাছে। তার বাবার চাচাতো ভাই। নতুন ড্যাড তাকে একটুও ভালোবাসত না। কিন্তু মা পাঠাতে চায় নি ব্যারিস্টার চৌধুরীর কাছে, কেননা সেও ততদিনে দ্বিতীয়বার স্ত্রী নিয়েছে। অবশেষে করাচির নিঃসন্তান আঙ্কল কোলে তুলে নিয়েছে ববকে।
নাসিমা বুঝতে পারে, বাবা তাকে আজ ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাকে ধরে রাখতে পারেনি। বব বলল, আই উইল কাম ব্যাক টু মাই আঙ্কল। আই হেট মাই ফাদার! আই হেট হিম। অভিমানে ববের চোখ সজল হয়ে উঠলো। চোখ নামিয়ে সে সমুখের ছাইরঙা কুশনে লাথি ছুঁড়তে লাগলো আস্তে আস্তে।
আর নাসিমা তার পায়ের দিকে তাকিয়ে পাথরের মত বসে রইলো। একটু পরে বব সিটে হেলান দিয়ে নাসিমার উল্টো দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে রইলো এতটুকু একটা পাখির মত। ঘুম এলো না নাসিমার। দুচোখ ভাব শুধু ঘুমের আর্তি। আর কিছু নয়। চব্বিশ বছর বয়সে যখন তার বিয়ে হয়েছিল সেই লোকটার সঙ্গে, তখন থেকে ঘুমের ওষুধ তার অভ্যেস হয়ে গেছে। আজকাল তিনটে ট্যাবলেট না হলে নাসিমার ঘুম আসে না। কিন্তু হোস্টেস দিয়ে গেছে একটা। শুধু একটা। এতে এমনকি তাও এলো না তার। কেবলি পেছনে ফেলে আসা। গ্রাম, ফসল, শহর আর পার্কের বৃক্ষবীথি আর ক্লিফটনের বালুকাবেলা। বব, ইউ আর এ ব্রেভ বয়—-বব, ইউ আর গোয়িং টু ইওর ড্যাড–বব–বব।
বব। ডাকলো নাসিমা।
তাকিয়ে দেখল বব নিস্পন্দ পড়ে আছে। শিথিল হয়ে এসেছে তার সারাটা শরীর। সমস্ত মুখে একটা অভিমান ফসিল হয়ে আছে।