যে পৃথিবী আমি সৃষ্টি করতে চেয়েছি, তোমার নিষ্ঠুরতায় তা বারবার ভেঙ্গে গেছে। আমি সরে এসেছি। পালানো, শুধু পালানো। থুতু আর কাদার আলপনা ধৌত করে অমলিন হতে পারলাম না—-এড়াতে পারলাম না স্মৃতির নখব। পালানোর শক্তিটুকুও আজ আমার শেষ হয়ে গেছে। এক মুহর্তে যা সত্যি বলে আঁকড়ে ধরি, পর মুহূর্তে তা মিথ্যে হয়ে যায় ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয়।
কেন একেকটা মানুষ হবে অমন নিষ্ঠুর? হয়ত আমাকে মরতে হবে তাই। কিন্তু আগুনে পুড়ে পুড়ে আমি খাঁটি সোনা হতে পারলাম না, হয়েছি ছাই করুণ একমুঠো ছাই। শুধু ছাই। বেবি, তুমি আমার বাহু ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যেও না।
.
আমাকে তোর কী মনে হয়, বেবি?
বেৰি গভীর চোখে তাকিয়ে রইল শুধু। নাসিমা তখন যোগ করল, আমাকে তুই ঘৃণা করবি? —-যেমন সবাই আমাকে করে?
না।
সত্যি। আমাকে দেখে তোর ভয় হয় না?
কেন?
আমি যে অমঙ্গল।
হোক। তুমি আমার মা।
নাসিমার চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো আলোর মত।
আমার গা ছুঁয়ে বল, সত্যি।
বেবি তাকে স্পর্শ করলো।
প্রথম দিনে মনে আছে তোর? তুই এসেছিলি তোর প্রফেসরকে খুঁজতে। আমি তোকে বসতে বললাম। তোকে দেখে অবধি আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল তুই আমার অনেকদিনের হারানো ছেলে। আমার সন্তান নেই আমার অংশ থেকে জন্ম নিয়েছে যে চেতনা, তুই যেন তার রূপ ধরে সেদিন সন্ধ্যেয় আমার দুচোখ আলো করে এসেছিলি। বলেছিলি তোর মা নেই। মারা গেছেন সেই ক—-বে। আমি যে তোর মা তুই কি তা তখন বুঝতে পারিসনি? আমার দুবাহু আকুল হয়ে উঠেছিল তোকে ধরে রাখবার জন্যে। তুই সেদিন খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলি, না?
নাসিমা যা ভাবছিল তা খানিকটা এমনি। কেবল শেষ কথাটা শব্দ হয়ে গড়িয়ে পড়ল ঠোঁট থেকে। বেবি শুধালো বুঝতে না পেরে, কবে?
কিছু না, বেবি। আমার হাতটা তুই ধরে থাক। বল, আমাকে তুই ফেলে যাবি না।
না, আমি যাবো না। আমি তোমার কাছে থাকব।
বেবি তার দুচোখ দিয়ে নীরবে এই অঙ্গীকার পাঠাল নাসিমাকে।
অনেকক্ষণ পরে নাসিমা বলল, লেখাপড়া শেষ করে বাসা নিতে পারবি না? আমি তখন তোর কাছে এসে থাকব। তারপর বউ আনব ঘরে। সোনার মত বউ।
বেবি লজ্জা পেল।
হ্যাঁ সত্যি, আমি কি মিছে বলছি? আমার কোল ভরে উঠবে তোদের পেয়ে। আমার আর কোনো ভাবনা থাকবে না। এত সুখ কি আমার সইবে, বেবি?
বলতে বলতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল নাসিমা।
বেবি চঞ্চল হয়ে উঠলো।
অশ্রু ঝরে পড়ছে নাসিমা চোয়ালের পাশ দিয়ে, শীর্ণ কণ্ঠনালির দুপাশে। কিন্তু কোনো বিকার নেই সারা মুখে।
বেবি মুছে দিতে চাইলো অশ্রু।
কাঁদছো কেন? এই তো আমি আছি।
আমাকে কাঁদতে দে, বেবি। এ আমার সুখের দিন।
.
তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে, সে টের পেল, মৃত্যু তার মুখ স্পষ্ট করে তুলেছে মনের অন্ধকার জানালায়। রক্তের ভিতর এই টের পাওয়া, ওপর থেকে যা বোঝা যায় না।
ঢাকায় ফিরে যখন এসেছিল তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। নাসিমা বলেছিল এ বেলাও বাইরে খেয়ে, তারপর বেড়িয়ে বাসায় ফিরবে। আসলে, বেবিকে সে এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিতে চায় না। তাছাড়া, মতির মা–র হাসিটুকু তার কাছে বিষ হয়ে আছে কাল থেকে। ক্যাসবা–য় বসে ছিল ওরা। ঠিক তখন এই অনুভব।
বেবির কয়েকজন বন্ধু এসে ঢুকতেই চঞ্চল হয়ে উঠেছে বেবি। নাসিমা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছে, এক মুহূর্তে বেবি আর বেবি থাকলো না—-পরিবর্তিত হয়ে গেল তার মুখ। আশঙ্কায় শুধিয়েছে, কী হলো?
কিছু না।
বলে বেবি চোর চাহনিতে তার বন্ধুদের দেখে নেয়।
বেবি কি ভয় পাচ্ছে ওদের দৃষ্টিকে? তুমি কি অনুতপ্ত হচ্ছ, বেবি?
নাসিমা চুপ করে খেতে লাগল। খেতে খেতে টের পেল বেবি তাকে দেখছে মাঝে মাঝে চোখ তুলে। আর তাকাচ্ছে দূরে, যেখানে ওর বন্ধুরা বসে হৈহৈ করছে।
বেবিকে ওরা যখন ডাকলো তখন বুকের স্পন্দন যেন মুহূর্তের জন্যে থেমে গেল নাসিমার। মনে হলো পায়ের নিচে সিমেন্টে প্রাণ এসেছে—- সরে যেতে শুরু করেছে। নাসিমা জোর করে মেঝেয় পা স্থির রাখতে চেষ্টা করল।
সারাটা গা তার থরথর করে কেঁপে উঠতে চাইলো। আবার সেই মুহূর্তগুলো ফিরে আসছে, মেঝের মোজাইক যেন সরীসৃপের মত কিলবিল করছে। দূরে মেঝের শেষ সীমারেখা সমতল থেকে উঠে যেতে চাইছে ওপরে কানের কাছে কে যেন ফিসফিস করে তার নাম ধরে ডাকছে।
নাসিমা হাতের কাটা শক্ত করে ধরে এত জোরে যে লাগল নিষ্ঠুর দাগ বসে গেল করতলের কোমলে—-প্রাণপণ চেষ্টা করল স্থির হতে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল, না—-না।
স্থির হতে হতে শুনতে পেল বেবির কী একটা কথায় হো হো করে হেসে উঠলো ওরা। হাসিটা তীরের মত লকলক করে কাঁপতে কাঁপতে এসে পড়ে গেল তার টেবিলের ওপর।
বেবি ফিরে এলো।
কী বলল ওরা?
কিছু না।
আমার কথা?
বেবি নীরবে নড করল উত্তরে।
খুব সাধ হলো জানবার জন্যে বেবি ওদের কাছে তার কী পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু বেবি এখন এত একমনে খেয়ে চলেছে যে কোনো কথা সে তাকে শুধোতে পারল না। মনে মনে বলল, আমি জানতাম। তার অভিজ্ঞতা বলল, আমি জানতাম। তার অনেক মৃত্যু কাফন পরে উঠে এসে বলল, আমি জানতাম। সে নিজেকে অনুভব করল দ্রুত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। শিথিল হয়ে আসছে তার মুঠো।
বেবি, আমি তোমাকে শক্তি দেব। কেননা তোমাকে আমি কিছুতেই হারাতে পারি না।
মুখে বলল, তাড়াতাড়ি খেয়ে নে, বেবি। কাল তোর যে জুতোটা পছন্দ হয়েছিল, আজ কিনে দেব, টাকা এনেছি।