বেবি তার সমস্ত আদর আর প্রশ্নের মুখে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে দিয়েছিল। কিন্তু তবু তার মনে হয়েছে, এই মুহূর্তে বেবি কী ভাবছে তা আমি কোনদিনই জানতে পাবো না। কিন্তু কেন? প্রশ্ন করে নি, কেননা, অভিজ্ঞতা তাকে বলেছে আমরা কত কম বলতে পারি, তুলনায় যা আমরা বলতে চাই। আর যদিও বা বলতে পারি, সেই প্রকাশের স্বরূপ কখনোই হয় না যথার্থ। তাই কী লাভ? যদি এমন হতো, যে আমার আপন তাকে কোনো প্রশ্ন না করে শুধু স্পর্শ দিয়ে স্পষ্ট করে জানতে পেতাম তার আত্মার প্রতিটি তরঙ্গ।
একেকটা মানুষ তার শরীরে নিজস্ব একটা পৃথিবী। একটা বিরাট আকর্ষণ তাদের তাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে নতুন একটা সৌরকক্ষের দিকে—-পরস্পর সেই আকর্ষণ–কেন্দ্র থেকে ধার করা আলোয় আলোকিত হয়ে উঠতে পারে কিন্তু যে কোনো কোণ থেকে মিলিত হওয়ার বাসনায় জ্বলে ছাই হয়ে শুধু নিশ্চিহ্নই হবে—- আর কিছু নয়। ব্যবধান কি তাই?
নাসিমা আখতার, আমরা কেউ উত্তর দেব না এই প্রশ্নের। একমাত্র যাকে তুমি শ্রদ্ধা জানাতে পারো তা মৃত্যু। একমাত্র যা তুমি অবলম্বন হিসেবে পেতে পারো তা মৃত্যু। একমাত্র যাকে তুমি নির্ভর করতে পারো তা মৃত্যু। আত্মার ভিতরে, পৃথিবীর জ্বলন্ত কেন্দ্রের মত, গুপ্ত, গতিমান মৃত্যুর অমর চক্র।
.
পাড়ে নেমে নাসিমা যেন হঠাৎ ছেলেমানুষ হয়ে গেল। এমন একটা চঞ্চলতা সে অনুভব করল তার শরীরে যা দুরন্ত বাতাসে কাঁপন লাগা পাতার অনুরূপ। নেমেই বলল, কী সুন্দর না?
উত্তরের অপেক্ষা করল না। চঞ্চল চোখে দৃষ্টি করতে লাগল চারদিকে, যেন মুহূর্তের সামান্যতম প্রাপ্তিকেও সে হারাতে চায় না। পায়ের স্যান্ডেল ছুঁড়ে ফেলে বলল, তুমি নাইবে না?
বারে, নইলে এলাম কেন?
বেবিরও তখন সেই লজ্জাটা হারিয়ে গেছে। তার তরুণ মুখ আরক্ত হয়ে উঠেছে রৌদ্রে। কথা বলতে বলতে সে শার্ট খুলে রাখলো। একে একে খুললো ট্রাউজার, ঘড়ি আর মোকাসিন। তারপর সবগুলো জড়িয়ে নৌকোয় ব্যাগের ভেতরে রেখে এলো। নৌকোটা এখান থেকে অনেক দূরে।
নাসিমা পানিতে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর আস্তে আস্তে ডুবতে লাগল তার শরীর। যখন শুধু গলা অবধি জেগে রইলো তখন বেবি দ্রুত দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার পাশে পানি আর রোদ ছিটিয়ে। টুক্ করে নাসিমা কপট বিরক্তিতে সরে গেল দূরে। আর তাকে ধাওয়া করলো বেবি। এক সময়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো দুজনে।
দিনের আলো আর বেবিকে বিব্রত করছে না। অন্য এক পৃথিবীতে কখন সে এসে দাঁড়িয়েছে। হাসতে হাসতে পানিতে হাসিতে একঠায় হয়ে গেছে নাসিমা।
এই বেবি!
নাসিমা একটা চাপড় দেয় কাঁধে আদর করে, কিন্তু মুখরেখায় ফুটিয়ে রাখে শাস্তি দেয়ার একটা প্রকট অভিব্যক্তি।
আমি তোমাকে কোনো মূল্যেই প্রতারিত হতে দেব না, বেবি।
বেবি তখন দ্রুত পানি ঠেলে হাঁপিয়ে তোলে নিজেকে। ফস ফস ডুব দেয় আর মুখ তোলে। বেবিকে আমি এত ভালোবেসেছি যে আমার হৃদয়ে তার কুলান হবে না।
.
পানিতে ভিজে দুজনের মুখ নতুন হয়ে উঠেছে। দুজনকে দেখাচ্ছে যেন দুটো বিরাট মাছ। নাসিমা বেবির পাশাপাশি সাঁতার দিতে থাকে।
বেবি।
উ।
বেবি।
বলো। বলো না?
না, কিছু বলবো না। তোর নাম ধরে শুধু ডাকব। ডাকব?
বেবি কিছু বললো না। এমনকি নাসিমার মুখে কখন যে সে তুমি থেকে তুই–তে রূপান্তরিত হয়ে গেছে তা বুঝতেও পারলো না। শুধু ভাবলো, নাসিমা তাকে এমন করে বেঁধে ফেলেছে যে আর কোনদিন তার বাঁধন থেকে সে মুক্ত হতে পারবে না।
বেবি, তুই দুষ্টু। ভারী দুষ্টু। দুষ্টু, দুষ্টু।
নাসিমা বেবির গায়ে পানি তুলে মৃদু আঘাত করতে করতে আধো চোখ বুজে উচ্চারণ করতে থাকে। আমার সব প্রীতি তোর জন্যে। স্পষ্ট অনুভব করতে লাগল তার হৃদয় পাত্র থেকে কী এক নামহীন তবল আধেয় আস্তে আস্তে নিঃশেষিত হয়ে যাচ্ছে। আর শূন্যতাটুকু ভরে উঠছে বেদনার মত মধুরতায়।
বেবি যেন পানিতে ভিজে ভিজে ছোট হয়ে যাচ্ছে।
বেবি উঠে এলো। তখনো পানিতে রইলো নাসিমা।
বেবি তাকে ভুল বুঝবে না। এই বিশ্বাসে এখন তার মন নত হয়ে এলো। বেবিকে সে কিছুতেই হারাতে পারে না। বেবি প্রবীর নয়, আনিস নয়, বেবির জন্যেই যেন সে দীর্ঘকাল মৃত্যুর পর মৃত্যু পার হয়ে এসেছে। বেবি, আমার বেবি।
নাসিমা গা ভাসিয়ে দিয়ে রইলো পানিতে।
মনের সমস্ত জটিল গ্রন্থিগুলো যেন খুলে যাচ্ছে একের পর এক অপরূপ এই শীতলতায়। মনে হলো অনেক ওপরে উঠে গেছে, পৃথিবীর মালিন্য ছাড়িয়ে, বাইরের নিয়মের বর্শা এড়িয়ে ওপরে অনেক ওপরে—-তার নির্মম অহংকার নিয়ে আত্মীয়তায় প্রীত হয়ে উঠেছে তার আত্মা সেই ঊর্ধ্বের সঙ্গে।
শৈবাল লতার মত নাসিমা আখতার শীতল–সবুজ, ভাবনাহীন, প্রয়াসহীন, প্রসারিত, দীর্ঘ, প্রবাহিত, আকণ্ঠ হতে লাগল দুপুরের বুড়িগঙ্গায়।
একটা ছায়ায় বসে প্যাকেট থেকে লাঞ্চ খেলো তারা। দুজনে দুজনার জন্যে এত প্রস্তুত হয়ে উঠেছে যে বড় একটা কথা হলো না এই সময়ে। বেবির মন চলেছে একটা সরল রেখায় নিজের কাছে অস্পষ্ট উৎস থেকে উৎসারিত কৃতজ্ঞতায় সে তখন থেকে বিনম্র, বাকহীন। অন্যদিকে নাসিমা যখন ছায়াটায় এলিয়ে শুয়ে পড়ল আকাশের দিকে মুখ করে তখন তার মনে নতুন একটা রূপ গড়ে উঠছে কোমল আভার মত আস্তে আস্তে।