আনিস ডুবে যাচ্ছে নেশায়। শেষ পানীয়টুকু তা সম্পূর্ণ করে দিয়ে গেল। তখন যেন উদ্দাম হয়ে উঠলো সে।
দিনের পর দিন দেখে আসছি, তুমি—-তুমি ভুলতে পারছ না।
নাসিমা এত বড় অপবাদ সইতে পারল না। কখনো কখনো সে স্মরণকে ফিরিয়ে এনেছে বৈকি, সেটাই অসহ্য হয়ে দাঁড়াল? বলল, তুমি ভুল করছে।
লায়ার।
সব তোমার ভুল।
ইউ বিচ।
শোনো, আমাকে তুমি ভুল বুঝো না, আমি তোমারই। ছি–ছি লোকে কী ভাববে বল তো? বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেল নাসিমা। আনিসের শেষ কথাটা যেন এতক্ষণে তার কানে গিয়ে পৌঁচেছে। কয়েক মাসের মিনতির পুতুল সে আজ চূর্ণ চূর্ণ করে ভেঙ্গে ফেলে দিল। বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ঋজু গলায় উচ্চারণ করল, আমার ঘর থেকে তুমি বেরিয়ে যাও। যাও বলছি। একশো বার আমি মনে করব, আমার যা খুশি করব, তোমার কী তাতে?
পশু, ছোটলোক। শ্রদ্ধা নেই যার হৃদয়ে তাকে আমার কোনো প্রয়োজন নেই।
আমার হৃদয় তুমি থুতু দিয়ে ভরে তুলেছ। আমি তোমাকে ক্ষমা করব কী করে?
কিন্তু আনিস নড়লো না। তখন নাসিমা নিজে বেরিয়ে এসে পাশের কামরায় খিল তুলে দিল। সারাটা শরীর তার বেতস–লতার মত থরথর করে কাঁপছে। দ্বিতীয় মৃত্যুর অনুভূতি বুঝি এমনি হয়।
অনেকরাত অবধি সেদিন লাবু চা বাগানের ম্যানেজার তার দরোজায় করাঘাত করেছে। শিলাবৃষ্টির মত আর অভিশাপ।
নাসিমা। নাসিমা। নাসি—-মা–আ।
তবু সে দরোজা খোলেনি।
আই উইল কিল দ্যাট সোয়াইন। আই হেট হিম। গিভ মি মাই গান। ইউ কাম আউট, নাসিমা।
তার উঁচু পর্দাটা নেমে এসেছে। থেমে গেছে করাঘাত। তখন বিড়বিড় করে, লেট মি ইন লেট মি ইন—-লেট মি ইন।
ঘুমের মত তার কণ্ঠস্বর যেন আস্তে আস্তে তলিয়ে গেছে। আর সারাক্ষণ নাসিমা অন্ধকারে লড়াই করেছে নিজের সঙ্গে।
.
এর পরে তাদের আর কোনো কথা হয় নি। পরদিন বিছানা পাশের ঘরে নিয়ে এসেছে নাসিমা।
চারদিন পর। সেদিন দুপুরে ঘুমিয়েছিল তার বিছানায়। সারাটা বাংলো দুপুরের নিশুতি নূপুরে আর বাইরের চোখ ধাঁধানো রোদে নিমগ্ন হয়েছিল।
হঠাৎ কী একটা শব্দে আর নিঃশ্বাসের উষ্ণতায় তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। যেন কেউ তাকে জাগিয়ে দিল অতি সন্তর্পণে। মুখ ফেরানো ছিল জানালার দিকে। চোখ মেলেই পাহাড় আর স্তব্ধ নিবিড় আকাশ। অনুভব করল মনে মনে সেই মানুষটার উপস্থিতি। তুমি কি অনুতপ্ত? আমি আর বহন করতে পারছি না, আমার অভিমান এত বিশাল হয়ে উঠেছে। তুমি একবার ডাকো, ক্ষমা করবার জন্যে আমার মন আকুল হয়ে আছে। ধীরে ধীরে মুখ ফেরালো নাসিমা।
চোখে চোখ পড়তেই যেন বধির হয়ে গেল সে। চিৎকার করে উঠল, না—-না।
আনিসের মুখ অনুতাপে নয়, লালসায় ক্ষুধায় আরক্ত হয়ে উঠেছে। ঠিক তখন সমস্ত শরীর আর মন ঘৃণায়, বিদ্রোহে, বঞ্চনায় বিদীর্ণ হয়ে গেল। একটা বমি উলটে আসতে চাইলো পাকস্থলী থেকে। জট পাকিয়ে কঠিন হয়ে গেল শরীরের প্রতিটি স্নায়ু। এ তুমি কি করলে আমার?
এরপর দুদিন পর পর ফিট হলো নাসিমা। আনিস দৃষ্টি করলেই, মনে হতো কতগুলো কীট যেন শরীর বেয়ে উঠতে চাইছে। গোসলের জন্যে মনটা অধীর হয়ে উঠতো। মিথ্যে, সব মিথ্যে। শরীরটাকে তখন একটা ভার মনে হতো তার যা তাকে চিরকাল বইতে হবে।
কাদার আলপনা আর থুতু। কাকে আমি ক্ষমা করতে চেয়েছিলাম? আমি সাজিয়ে নেবো আমার পৃথিবী আমার জন্যে। আমার অহংকার তোক নির্মম।
আসামকে পেছনে ফেলে কলকাতায় এলো নাসিমা।
৪. উজ্জ্বল রোদে সারা বুড়িগঙ্গা
উজ্জ্বল রোদে সারা বুড়িগঙ্গা যেন সোনা হয়ে আছে। ঢেউয়ের দোলায় উঠছে পড়ছে নৌকো, ছোট বড় নৌকো। দুপাশের ছড়ানো গ্রাম আর দূরে ঘন গাছের সারি আর খেত মাঠ—-জল রংয়ে আঁকা বিশাল একটা ছবির মত মনে হচ্ছে।
পৃথিবীতে এত আলো আছে, নাসিমা কি তা জানতো?
ছইয়ের পিঠে হেলান দিয়ে, শরীরের নিচে শীতল স্রোত প্রবাহ অনুভব করতে করতে নাসিমার মনে হলো, যে মুখটা ছাইমাখা হয়েছিল এতকাল, আজ হঠাৎ তা ধৌত হয়ে গেছে। পৃথিবী তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছে তার এই রৌদ্র দিয়ে। বেবিও পাশের গলুইয়ে চুপচাপ বসে দাঁড় টানা দেখছিল।
দিনের আলোর এমন একটা জয়ী মনোভাব আছে যে রাত্রির সমস্ত চিন্তা, চেতনা আর সিদ্ধান্তকে হাস্যকর করে দিতে চায়। কাল রাতে নাসিমার যে সংলাপগুলো তাকে স্বপ্নের সংকেত এনে দিয়েছিল আজ তা মনে করে লজ্জায় রক্তিম হয়ে উঠছে বারবার বেবি।
নৌকোয় আসবার উদ্যোগটা ছিল নাসিমার।
কতদিন সাঁতার কাটিনি। এখানে সাঁতারের সুবিধে নেই, বেবি?
কি জানি। ভালো পুকুর তো নেই।
নদী? ভাড়া নৌকো মেলে না?
খুব।
তাহলে কাল চল। যাবে?
আজ তাই বেরুনো।
বেবির সঙ্গে সাক্ষাতের পর থেকে নাসিমা আশ্চর্য রকমে কদিন থেকে শান্ত হয়ে আছে। কেবল একটা মুক্তি, একটা পরমপ্রাপ্তি, দীর্ঘকাল ধরে কেবলি বঞ্চনার পর। সেই সুখ হীরে হয়ে আছে নাসিমার সত্তায়।
নাসিমা বাইরের উজ্জ্বল পৃথিবীর সঙ্গে বহুদিন পরে নিবিড় আত্মীয়তা অনুভব করছে আজ। পেছনে কত দূরে ফেলে এসেছে ঢাকা।
বেবি।
বেবি তখন এপাশে এসে বসলো। বসে চলমান দৃশ্যের দিকে মনোযোগী দৃষ্টি করে রইলো। কী ভাবছ?
কই কিছু না। দেখছি।
মিছে কথা। আমি জানি তুমি কী ভাবছ। বলব?
নাসিমা ব্যথা অনুভব করলো বেবি লুকোচ্ছে বলে। আসলে হয়ত বেবি লুকোয়নি কিছুই ওটা নাসিমারই একতরফা ধারণা। বেবির চুলে হাত দিয়ে কাল রাতে মুঠো করে ধরতে ধরতে সে একটা বিয়োগ অনুভব করেছে। তীব্র একটা বিয়োগ। কেন এই ব্যর্থতা? বেবির সমস্ত কিছু সঞ্চিত, উঘাটিত, মিলিত হোক তার অন্তরে। আর কোনো বাধা, কোনো দূরত্ব, কিছুই নয়। এমন কী দুরাশায় তার মনে হয়েছিল বেবি গলে গলে সুধা হয়ে যাক, আমি সেই সুধা পান করবো।