.
এই কষ্ট পাওয়ার নেশা বিস্তৃত হয়ে ছিল বিয়ের পর অবধিও। বরং আরো নিবিড় করে অনেকদিন মনে পড়েছে সেই মানুষটাকে যে তার আত্মাকে চিরকালের মত নিঃসঙ্গ করে গেছে।
আর লাবু চা বাগানের সেই মানুষটার নাম কী ছিল? আশ্চর্য তার নামও আনিস। শুধু উপাধিটা আলাদা।
নাসিমা প্রথম দিনই নাম শুনে চমকে উঠেছিল। কিন্তু বুঝতে দেয়নি হামেদকে। মনে মনে তার ভাবনা এসেছে, যেন এক নামের দুটো মানুষ—-একটা সাধারণ বিন্দু থেকে পরস্পরের বিপরীতে তীরের মত দুটি রেখা ছুটে গেছে। তাদের গতিতে, দৈর্ঘে, বর্ণে কোনো মিল নেই। অস্পষ্ট একটা সহানুভূতি কিংবা সঠিক করে বললে কৌতূহল হয়ত গড়ে উঠেছিল এই নতুন আনিসের জন্যে।
লাবু চা বাগানের ম্যানেজার আনিসের বাংলো আলো করে আমি এসেছিলাম। কিন্তু সে আলো নিভিয়ে দিয়েছে আনিস নিজে।
.
বাংলার দুকামরার মাঝখানে উঁচু টুলের ওপর জ্বলছিল পেট্রোম্যাক্স।
শরীরটা ছায়ায় আবৃত হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠেছিল নাসিমা। ম্লানগতি চলচ্চিত্রের মত শিথিল ভাসতে ভাসতে ছায়াটা তাকে জড়িয়ে ধরছে, শ্বাপদের আলিঙ্গন যেন।
নাসিমা জানে কে এলো। এমনি ছায়া আজ কয়েক মাস ধরে তার শরীরে পড়েছে। তাই প্রথমে চমকে উঠলেও মুখ ফেরাল অনেকক্ষণ পরে, আস্তে আস্তে।
মুখ ফিরিয়ে দেখল—- আনিস। খাকি ট্রাউজার এখনো পরনে, সেটা পরে সারাদিন চা বাগান ঘুরে এসেছে। কেবল উধ্বাঙ্গ উন্মুক্ত। হাতে হুউস্কির গ্লাস প্রায় আদ্ধেকটা এখনো ছলছল করছে গলিত সোনার মত।
আনিস কোনো কথা বলল না। তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। নাসিমার মনে হলো একটা পাহাড় তার পেছনে বিপজ্জনক রকমে বেড়ে উঠছে প্রতি মুহূর্তে। কেন কোনো কথা বলছে না আনিস?
কথা নয় পানীয় পানের শব্দ পেল নাসিমা।
গ্লাসটাকে টুলের ওপর রাখতে রাখতে আনিস বলল, আমি জানি তুমি কার কথা ভাবছ।
নাসিমা যেন জানত আনিস এ কথা বলবে তাই স্তব্ধ হলো না তার রক্তপ্রবাহ। এমন কি যখন হঠাৎ আনিস চিৎকার করে উঠল, তখনও না। আনিসের বীভৎস দ্রুত কণ্ঠস্বরে বাংলোর দেয়ালে দেয়ালে করাঘাত বেজে উঠল যেন।
আমি চাই না আমার সমুখে কেউ থাকবে। বুঝেছ? ইউ আন্ডারস্ট্যাণ্ড?—-নো মেমোরি নাথিং—-আই হ্যাড এনাফ অফ দোজ।
নাসিমা কিছু না বলে উঠে দাঁড়াল। চলে গেল পাশের কামরায়। স্মরণ কি পাপ? ভাগ্যের পরিহাস, দুজনেরই এক নাম।
চলে যেতে যেতে নাসিমা শুনতে পেল আনিস তার চেয়ারটাকে লাথি মেরে সরিয়ে দিল। তারপর আর কিছু না। অন্ধকার কামরায় গিয়ে শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিল নাসিমা। শুধু শরীর নয়, মনের দিক থেকেও এত ক্লান্ত লাগছে তার যে সামান্যতম প্রতিবাদেরও কোনো স্পৃহা নেই তার।
আনিস হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল দেখে একবার মনে হলো উঠে গিয়ে দেখে আসে কী হলো লোকটার?—-যেন চিৎকার করে সব কিছু ছিটিয়ে ছড়িয়ে ফেললেই সে নিশ্চিত হতে পারত। তারপর বালিশে মুখ লুকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল সে এক সময়ে। আস্তে আস্তে মন থেকে কান্নার স্পষ্ট কারণটা অপসারিত হয়ে গেল—-শুধু বেঁচে রইলো কান্না।
.
তুমি মদ খাও আনিস, আমি তাতে কোনদিন কিছু মনে করিনি। বরং বিয়ের পর এখানে এসে যেদিন জানলাম, মনে মনে একটা আঘাত পেলেও, বার থেকে আমার হাসিমুখ দেখে তুমি যে প্রীত হয়েছিলে সেটাই ছিল আমার সোনার মত পাওয়া।
আমি তোমাকে অবলম্বন করে পূর্ণ হয়ে উঠতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু বিপরীতে আমাকে তুমি বুঝতে চাইলে না। আনিসকে আমি ভুলে যেতে পারিনি, কিন্তু তোমাকে তো ফিরিয়ে দিই নি? সুদূর একটা দ্বীপের মত করে কাউকে মনে রাখা কি পাপ? আনিস আমার জন্যে মরে গেছে। মৃতকে যদি ভুলে গিয়ে না থাকি তার মানে কি এই যে, জীবিতকে আমি অস্বীকার করছি? নিজেকে আমি শ্রদ্ধা করব না? আমার ফেলে আসা আমাকে?
বিয়ের পর নাসিমা মনের সমস্ত কথা খুলে বলেছিল স্বামীকে। নিজেকে নিবিড় আলিঙ্গনে সঁপে দিয়ে বলেছিল, যখন আনিস শুধিয়েছে, তোমার কথা বলো। বলবে?
বলবো।
তারপর প্রথম প্রেমের কথা বলতে গিয়ে, তার নামও ছিল আনিস।
মরে গেছে?
আমার কাছে।
তখন আনিস বুঝতে পারেনি—- আনিস মরে গিয়ে কী চরম শোধ নিয়েছে তার ওপরে। তখন সে বলেছে, আমি তোমার আনিস। যে গেছে সে চলে গেছে।
যে গেছে সে চলে গেছে সত্যি, কিন্তু মনের নিয়ম মানে না কোনো যুক্তির সিঁড়ি। বিষুব রেখা পার হয়ে এলে যেমন উত্তর থেকে এসে থাকি দক্ষিণে—-আর দুচোখে থাকে না তখন উত্তরের আকাশ, তখন শুধু দক্ষিণ, মনের পৃথিবী তো তেমন নয়!
একটা ছবির ওপর আরেকটা ছবি এসে পড়ে, দুটো মিলে নতুন ছবি হ্য। পেছনেরটা মুছে যায় না। পরে পরে আরো ছবি–আরো আকাশ। আঘাতের পর আঘাতে ভেঙ্গে যেতে থাকে প্রেক্ষিত। জ্বলে পুড়ে তখন ছাই হয়ে যেতে থাকে হৃদয় আর আত্মা আর স্মৃতি আর স্নায়ু আর চেতনা যে আগুন আজ জ্বলছে নাসিমার।
সেদিন যদি তার কখনো কখনো এই মনে রাখা মেনে নিতে পারত আনিস, তাহলে কী হতো? তাহলে আমাকে বারবার মরে গিয়ে নতুন জন্মের জন্য অধীর হয়ে উঠতে হতো না। তুমি আমার, সম্পূর্ণ আমার, কমপ্লিটলি, আর কারো কথা আমি জানতে চাই না।
আনিস ঘরে এসে নতুন করে পানীয় ঢালতে ঢালতে বলল—- দেয়ার মাস্ট বি নো ওয়ান। ইউ হিয়ার?
আবার কান্না পেল নাসিমার। সম্পূর্ণ করে সে দিতে চেয়েছে, দিয়েছে নিজেকে। যদি মনে পড়ে থাকে প্রথম প্রেমের কথা, তা কি তুমি সূহ্য করতে পারো না? মনে মনে সে মিনতি করল স্বামীর উদ্দেশে আমাকে তুমি এতটক দাও, তোমাকে আমার কোনো অনীহা স্পর্শ করবে না, আমার মনে কোনো মালিন্য নেই—- এ কথা তুমি বিশ্বাস করো একবার।