.
সারারাত খুব বাতাস বইছে। সেই বাতাসের হাহাকার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল নাসিমার। পৃথিবীতে আজ এত হাহাকার কেন? কান পাতলে যেন একটা উত্তর শোনা যাবে দূর পৃথিবীর অন্তস্থল থেকে।
নাসিমা উঠে পানি খেয়ে এসে শুয়ে পড়লো আবার। বালিশটাকে আঁকড়ে ধরলো শিশুর মতো। আরজুর এই শোবার ঘর যেন আস্তে আস্তে বাতাসের ধাক্কায় বিশাল থেকে বিশালতর। হয়ে আসছে। প্রতি মুহূর্তে প্রসারিত হচ্ছে তাকে আরো ক্ষুদ্র করে দিয়ে। বেবির মুখ অনেকক্ষণ ধরে ভাবতে চেষ্টা করলো নাসিমা। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলো না। এমন কি মুখের সামান্য একটা ভঁজ কিংবা একটা কোণও তার মনে পড়ল না। আমি কিছুতেই মনে করতে পারছি না। অথচ আজ শিশুরাত্রিতে তার মুখ আমি দুহাত ভরে তুলে নিয়েছিলাম।
নাসিমার মনে হলো সে একটা ভাসমান পাটাতনের ওপর শুয়ে আছে। দুলছে। ফুলে ফুলে উঠছে।
বেবির মুখ মনে করবার চেষ্টাটাও এক সময়ে হারিয়ে গেল। শুধু একটা শূন্যতা। আর বাতাসের ভয়। আর আরজুর কামরার বিশালতা। নাসিমা বালিশটাকে আরো আপন করে আঁকড়ে ধরলো সারাটা শরীর গুটিয়ে এনে এতটুকু একমুঠো করে।
.
আনিস বলেছিল তোমার মুখ আকাশের মতো। কৈশোরের সেই রক্তিম বয়সটা থেকে শুরু করে তেইশ বছর বয়স অবধি তাকে পূর্ণ করে রেখেছিল আনিস। আনিসকে তার আত্মার চেয়েও গভীর করে ভালোবেসেছিল নাসিমা। পৃথিবীকে আমার অযুত কৃতজ্ঞতা, আমার আর কোনো প্রার্থনা নেই। আমার মৃত্যুর মুহূর্তেও যেন দুচোখ ভরে উজ্জ্বল হয়ে থাকে আনিসের মুখ।
কিন্তু সাপ–সাপকে কি কেউ মনে রাখে?
আনিসের অস্তিত্ব একটা সাপের মত পিচ্ছিল, কৃঢ় সত্তায় রুপান্তরিত হয়ে গেছে এক সময়ে। তোমাকে আমার অদেয় ছিল না কিছু। তুমি আর কী চেয়েছিলে আমার কাছে?
এসব প্রশ্নের উত্তর সে কোনদিন পাবে না।
শুধু একদিন সে তাকিয়ে দেখেছে—-আনিস দূরে সরে যাচ্ছে। আনিস খুঁজে নিচ্ছে তার নতুন বন্দর।
হামেদ তার চুলে হাত বুলোতে বুলোতে বলেছে, সিমু, তোর কী হয়েছে বলতো? কিছু না, কিছু না।
কিন্তু কণ্ঠস্বর ছিল তার বাষ্পে আকুল।
মনে আছে, হামেদ তখন তাকে খুশি করে তুলবার জন্যে কী–ই না করেছে। হামেদ তো। জানতো না, আমার এ দুঃখ অন্তরে বাহিরে এমন কিছু নেই ভুলিয়ে দেয়। হামেদ তাকে সারাক্ষণ নিয়ে বেরিয়েছে সিনেমায়, রেস্তোরাঁয়, জিনিস কিনে দিয়েছে রাশ রাশ। বলেছে, তোর যা খুশি বল——– আমি আছি কী করতে? আমি এনে দিচ্ছি। একেক সময় নাসিমারও বিশ্বাস করতে লোভ হতো এমনি করে হয়ত সে পেয়ে যাবে একদিন সব ভোলানো এক বিস্মৃতি। মগ্ন হয়ে থাকতো, থাকতে চেষ্টা করতো। কিন্তু কিছুতেই যে আর কিছু হবে না, একেকটা মনের মনে রাখবার ক্ষমতা যে এমনি অসাধারণ, এটা সে উপলব্ধি করতে পেরেছিল আরো অনেক পরে।
কিন্তু তখন একেকদিন খুব করে সজ্জা করে, নতুন কেনা উজ্জ্বল শাড়িটা পরে, বাইরের চলমান স্রোতে নিজেকে প্রবাহিত করে দিয়ে ভাবতো এই আমি বেরিয়ে আসতে পারছি স্মৃতির থাবা থেকে। হয়ত তা সফলও হতো কিছুক্ষণের জন্যে, কী একটা দিনমানের জন্যে, কিন্তু যখন হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ত তখন দিনের পর দিন চোখ তুলে কারো দিকে তাকাবার শক্তিটুকু অবধি থাকতো না। নিজেকে তখন চরম একটা অবহেলা আর অযত্নের হাতে ছেড়ে দিয়ে নাসিমা শিক্ষিত করত নিজেকেই। এতটুকু কষ্ট তার সইতে পারেনি কেউ কোনদিন। হামেদও না। বার থেকে যতটুকু বোঝা যায় তার কষ্টের রূপ দেখে হামেদ ব্যথিত হতো, কিন্তু কিছুই করতে পারত না।
হামেদের আকুলতা দেখে নিজের ওপরেই আক্রোশ হতো নাসিমার। কেন আমি হামেদকে বিচলিত করে তুলছি তার মমতামূল অবধি?
একদিন সকালে উঠে সে প্রাণভরে নাইলো। নেয়ে আসবার পর নাশতার টেবিলে বসে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, আবার সে পড়বে। এম. এ. দেবে—- সেটা এতদিন শুধু উৎসাহের অভাবে পড়ে ছিলো। হামেদ বলল, বেশ তো।
হামেদের স্বস্তি–সুন্দর মুখখানা তখন কী যে ভালো লেগেছিল নাসিমার।
—-পরীক্ষা দিবি এতো ভালো কথা। আমিও এদ্দিন তাই ভাবছিলাম। চল আজকেই, রি অ্যাডমিশন করিয়ে নি, কী বলিস?
চলো আজকেই। আর কিছু বইও কিনতে হবে। আর আমাকে, ভাইয়া, পড়বার জন্যে, হালকা একটা চেয়ার কিনে দেবে কেমন?
এত স্বচ্ছ সহজ কণ্ঠে সে কথা বলতে পারছিল তখন যে তার নিজের কানেই মনে হচ্ছিল অন্য কারো সুন্দর স্বর সে শুনতে পাচ্ছে।
হামেদের তখুনি হুকুম হলো বারান্দার কোণ খালি করে দেয়ার জন্যে। ওখানে সকালের রোদে, ঘরে যদি ভালো না লাগে, নাসিমা পড়তে পারবে। আর স্ত্রীকে বলল বাক্স থেকে একটা পর্দা এনে কোণটাকে আড়াল করে দিতে।
সন্ধ্যের ভেতরেই হামেদ এত নিপুণ হাতে সব আয়োজন করে দিল যে, নাসিমার মন ভীষণ রকমে প্রসন্ন হয়ে উঠলো। অনেক রাত অবধি পড়লো সে সেদিন।
সেই মাসগুলোতে সুখ কিংবা দুঃখ কিছুই আর সে যেন অনুভব করতে পারত না। এমনি করে পরীক্ষা দেয়া অবধি। নিজেকে সে একটা কোনো বৃত্তিতে নিযুক্ত রাখতে পেরেছে এটাকে তখন অবধি মুক্তি বলে মনে করলেও পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার পর আর তা রইলো না।
আবার নিঃসঙ্গতা। আবার বরফের কুচিতে যৈন সে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে আছে এমনি প্রাণহীন শীত। দূর থেকে কতদিন আনিসকে দেখেছে কিন্তু মুখ ফেরায়নি। আনিসের জন্যে কষ্ট পাবে কিন্তু আনিসের কাছে আর সে ফিরে যাবে না।