সারাটা কামরায় ছিলাম আমরা দুজন। আজ থেকে আমি থাকব না। শুধু পারুল থাকবে। তারপর হয়ত, হয়ত কেন নিশ্চয়ই, অন্য কেউ আসবে। নাসিমার মনে একটা বেদনার দল মেলে উঠতে চাইল। সেও কি তার নিজের মত করে ভালোবাসবে পারুলকে? তার পারুল? চকিতে ঘুরে তাকাল নাসিমা।
পারুল তেমনি স্থির দাঁড়িয়ে আছে। দরোজার ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছবির মত স্তব্ধ তার শরীর। পারুলের কষ্ট হচ্ছে।
কষ্ট হলো নাসিমার।
চোখে চোখ পড়তে পারুল দৃষ্টি নাবিয়ে নিল।
তখন নাসিমা এগিয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রাখলো, থরথর করে কেঁপে উঠলো পারুলের দেহ। নাসিমা কিছু বলল না। স্পর্শের তরঙ্গে তরঙ্গে শক্তি প্রবাহিত করে দিতে চাইল পারুলের আত্মায়। কিন্তু শক্তি নয়, প্রবাহিত হলো বেদনা। পারুলের চোখ থেকে মুক্তো পড়ল ঝরঝর করে।
নাসিমা বলল, তুই কাঁদছিস কেন? আমি কি চিরকাল থাকব? আর আমি থাকলে কষ্ট যে তোর। তোর কষ্ট আমি কী করে দেখব, পারুল? আমি–নাসিমার স্বর তার নিজের কানেই শোনালো রুক্ষ, কর্কশ সেটাকে চাপা দেয়ার জন্যেই কথা বন্ধ করলো নাসিমা।
.
পারুল আর পারলো না। কান্নায় বিকৃত কণ্ঠে উচ্চারণ করল, আমি কী করব? আমি এখানে থাকতে পারব না। আমাকে তুমি নিয়ে যাও।
পাগল। আমার জন্য তুই মরবি কেন? আর আমি চলে গেলেই নাসিমা হাসতে চেষ্টা করল এখানে কেউ কিছু বলবে না। মানুষের নীচতাকে আমি ভয় পাই, পারুল। শক্তি নেই, নইলে লড়তাম। তাই পালিয়ে যাচ্ছি।
আমারো শক্তি নেই নাসিমা আপা।
আছে।
দৃঢ়কণ্ঠে এই উত্তরটা নাসিমা বিশেষ করে উচ্চারণ করল।
—-আছে, থাকবে না কেন? সবাই কি আমার মতো?
পারুলের জন্যে আমার মমতা হচ্ছে। কিন্তু আমি কী করব?
আমি চলে গেলে তোর খুব কষ্ট হবে জানি, কিন্তু আমার উপায় নেই। পারুল, শোন—-
পারুল আঁচলে মুখ ঢেকে বলল, তুমি কী নিষ্ঠুর নাসিমা আপা।
নাসিমা তখন চুপ করে ভাবতে লাগল পারুলের মুখ, যা সে গতরাতেও চুমোয় চুমোয় নিবিড় করে তুলেছিল।
নাসিমার সমস্ত শরীর জ্বালা করতে লাগল। পুড়ে পুড়ে যেতে লাগল একেকটা স্নায়ু। পারুলকে একেলা ফেলে বাথরুমে এলো নাসিমা। এসে গায়ে পানি ঢালতে লাগল টাব থেকে।
পারুল বোধ হয় কাঁদছে। আমি যে মরে গেছি, একথা পারুল বুঝবে কী করে? এখন দূর থেকে শুধু ওর দুঃখটা বুঝতে পারি, কাছে গিয়ে সান্ত্বনা দেয়ার শক্তি আর আমার নেই।
.
কলকাতা থেকে চলে এসে নাসিমা নতুন করে একটা মুক্তির সন্ধান পেয়েছিল পারুলের সান্নিধ্যে। স্কুলের সবচেয়ে তরুণী শিক্ষয়িত্রী পারুল—- যে স্কুলে পড়াতে এসেছিল নাসিমা। প্রথমদিন ওর মুখ দেখে নাসিমার মনে হয়েছিল পারুল বড় অবলম্বনহীন। কিন্তু কত আপন, কত চেনা। একেকটা মুখ এমনি মিলে যায় পথ চলতে চলতে যাকে খুব চেনা লাগে—-মনের কোনো একটা অস্পষ্ট মুখের সঙ্গে আশ্চর্য রকমে মিলে যায়। নাসিমা বেঁচে গিয়েছিল পারুলকে পেয়ে। বোর্ডিং হাউসে নিজের কামরায় নিয়ে এসেছে ওকে কদিন পরেই। প্রথমে একটা ভয় ছিল পারুলের দিক থেকে, কিন্তু পরে দেখা গেছে, পারুলও যেন কতকাল ধরে প্রতীক্ষা করছিল নাসিমার জন্যে। পারুল বলেছিল, আমার মনে হয় তুমি না এলে আমি মরে যেতাম।
নাসিমা তখন বলতে পারেনি—-পারুল, তোমাকে না পেলে মরে যেতাম আমিও।
কী পেলাম বা কী পেলাম না—- এ প্রশ্ন পারুল আর তার ভেতরে জাগবে না কোনদিন। শুধু আত্মার সান্নিধ্য। শুধু উত্তাপ।
প্রবীর, আনিস, লাবু চা বাগানের সেই পশু–ওদের আঘাত করবার হাতিয়ার থেকে কত মুক্ত নাসিমার এই নতুন জীবন। ঘৃণায় অবিশ্বাসে যার মন ভরে উঠেছে তার মুক্তি কি আছে এমনি করে?
কোনো কোনো রাতে পারুল উঠে আসতে তার বিছানায়। তার উত্তাপে স্পন্দিত হয়ে উঠতে সে। পশুর উত্তাপ নয়; কোমল, শুদ্ধ, পরিচ্ছন্ন একটা অনুভূতি। পারুল এতটুকু হয়ে আছে তার বুকের ভেতরে। এইসব মুহূর্তে চিরদিনের মত মরে যেতে পারত নাসিমা।
.
গোসল সেরেও জ্বালাটা কমলো না। ফিরে এসে দেখল পারুল ঘরে নেই। থাকবে বলে মনে মনে আশা করেছিল নাসিমা।
এখানকার সবাই তার বিরুদ্ধে চলে গেছে পারুলকে কেন্দ্র করে। কাদা ছড়িয়েছে। ছি–ছি ছি। না, ও কথা আর মনে করবে না নাসিমা। নিজে রেজিগনেশন দিয়ে চলে যাচ্ছে—-এর বেশি তার কিছু করার ছিল না। একেক সময় মানুষের উদ্যত জুতোর মুখে নিজেকে এত অসহায় মনে হয়। স্কুলের সেক্রেটারী খুশি হয়েছেন একটা ক্ষত সারানোর গৌরবে। রেজিগনেশন লেটার হাতে নিয়ে তার মুখ দেখার মত হয়ে ছিল। অতি দুঃখে, ঘৃণায় হাসি। পেয়েছিল নাসিমার।
পারুল জানে, আমি বিনষ্ট কোনো বাসনার হাতে নিজেকে তুলে দিইনি। আমি কিছুতেই বোঝাতে পারব না, কাউকে না। আমার যে কত বড় আনন্দ এনে দিয়েছিল পারুল পারুলও জানবে না। তার জন্যে আমার দৃঢ় মুখটাই চিরকালের জন্য সত্যি হয়ে থাকবে। যাবার আগে নাসিমা কাছে ডেকে নিল পারুলকে। বলল, তোকে মমতা দিয়ে কবর দিলাম। আমি যাই।
পারুল উত্তরে কিছু বলল না। তখন নাসিমা কণ্ঠস্বর আরো নামিয়ে প্রায় ফিসফিস কণ্ঠে উচ্চারণ করল, নিজেকে কোনদিন মরে যেতে দিস না, পারুল।
আর কিছু বলল না নাসিমা। দ্রুত মুখ ফিরিয়ে বাইরে দাঁড়ানো রিকশায় গিয়ে উঠে বসলো। সঙ্গে সঙ্গে দুচোখের সমুখে বিছিয়ে থাকা কাঁচা রাস্তাটাকে তার মনে হলো কত দীর্ঘ। এক বছর ধরে চেনা এখানকার দুপাশে বাসা বাড়ি গাছ মনে হলো কত অপরিচিত।