.
বিছানার ওপর নিজেকে এলিয়ে দিয়ে পরম একটু স্বস্তি অনুভব করল নাসিমা আখতার। জীবন নয়, মৃত্যু নয়, ক্ষতি নয়—- কিছুই আর নয়। শুধু পূর্ণতা। এই পূর্ণতা কিসের বা কেন তা তার নিজের কাছেই ঠিক বোধগম্য নয়। স্পষ্ট যা তা শুধু তার এই বিশেষ অনুভূতি।
এই পূর্ণতা আমি কতকাল প্রার্থনা করেছি আমার স্বপ্নে আমার জাগরণে কিন্তু কেবলি আঘাত।
মতির মা এসে বলল, অন্ধকারে শুয়ে আছেন, আপামণি, বাতি দেব?
দে।
বাতি জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কেউ যেন তাকে কঠিন একটা দৈহিক আঘাত করলো। মুখটা মুহূর্তের জন্যে বিকৃত হয়ে এলো; পরে বলল, কী বলবি বল?
খাবেন না?
খাবার কথা আজ মনেই নেই তার। এমনকি মতির মা মনে করিয়ে দেয়া সত্ত্বেও সামান্যতম তাগিদও সে অনুভব করতে পারল না।
দৃষ্টি তার নিবন্ধ ছিল ঘরের কোণে রাখা টিপয়ের ওপর একটা উজ্জ্বল পদার্থের দিকে। উঠে বসে শুধালো নাসিমা, ওটা কী?
কোনটা?
কাছে গিয়ে নাসিমার নিজেরই হাসি পেল খুব। জার্মান কাঁচিটা ওখানে পড়ে আছে। আরজু যেভাবে মেয়েকে সাজাতে শুরু করেছে তাতে করে সেলাই কল না কিনে উপায় কী? কিন্তু মেয়েটা এখনো গোছালো হলো না; আগের মতই এলোমেলো। কাঁচিটা কি তুলে রাখতে হয় না?
অন্য কোনদিন হলে নাসিমা ভয় পেত ভীষণ রকমে ওই রূপোলি তীক্ষ্ণতা দেখে। আজ সে শুধু হাত দিয়ে কাঁচিটাকে আলোর সরলরেখা থেকে সরিয়ে রাখলো। পরে মুখ ফিরিয়ে বলল, কই, খেতে দিবি নে?
যেন অপরাধটা মতির মার–ই। কিন্তু মতির মা আজ আটদিন হলো দেখে আসছে নাসিমাকে; তাই এতে সে বিস্মিতও হয় না, বিরক্তও হয় না। শুধু বলে, না বললে দিই কী করে? ভালো কথা আপামণি, সন্ধ্যেয় আপনার জন্যে ফুল তুলে রেখেছি।
কথাটা শেষ করে মুখ টিপে হাসে। মুখটা তার চিকচিক করে ওঠে কৌতুকের তরঙ্গে। নাসিমা যেতে যেতে বলে, তরল কণ্ঠে, তুই মর মতির মা।
.
আজ সে তার শরীরে নতুন করে রক্তপ্রবাহ অনুভব করতে আসছে যেন। আর পৃথিবীর যেখানে যত সংকেত আছে সব কিছু যেন বোধগম্য হয়ে এসেছে। এত নির্ভরযোগ্য মনে। হচ্ছে তার নিজেকে যে, নাসিমা আপন মনে হেসে ফেলল, কেউ যদি আজ তাকে বলত গান গাইতে তাহলে সে অনুরোধ রাখত।
আজ খুব করে খেল নাসিমা। খেয়ে একটা দম আটকানো ক্লান্তি অনুভব করলো। তারপর জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
রাত অনেক হয়েছে। পথের বাতিগুলো তাই এত উজ্জ্বল। রাস্তার এখানে ওখানে চকচক করছে অ্যাশফট। আর কুকুর। আর একটা ঝড়ের মত মোটর কার।
নাসিমা এসে বসলো আরজুর আয়নার সমুখে।
তুমি আমার সন্তান। তোমাকে কেন্দ্র করে আমি বেঁচে থাকতে চাই অবিশ্বাসের এই পৃথিবীতে।
আয়নার সমুখে বসনেও প্রতিফলনের দিকে দৃষ্টি নেই তার। শুধু শুধু বসা। হঠাৎ বরফ হয়ে গেল যেন সব কিছু।
আজ কি বেস্পতিবারের রাত? নইলে ওই ভিখিবিটা কেন এমনি করে নিশুতি রাতে কান্না করে যাবে পথের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত অবধি? গত বেস্পতিবার রাতে, প্রথম যে দিন এসেছিল, অমনি হয়েছিল। এত করুণ, নিষ্ঠুর আর হিম করা তার আর্তনাদ। মতির মা বলেছিল, রোজ বেস্পতিবার রাতে আসে আপামণি।
আজও এসেছে। একটা অর্ধবৃত্তের মত পথ ধরে তার আর্তনাদ শোনালো নাসিমার শ্রুতিতে। নাসিমার মনটা চিৎকার হয়ে উঠতে চায়, হয় সে মরে যাক আর নইলে নিজে সে বধির হয়ে যাক।
হ্যয় কই আল্লাহ্ কা পেয়ারা, নবী কা দুলারা আন্ধা কো দো মুঠি খানা দে–এ–এ।
নাসিমা স্তব্ধ হয়ে অপেক্ষা করতে থাকে কখন সে ডাক মিলিয়ে যাবে দূরে। এক সময়ে চলে গেল। কিন্তু নিজেকে আর যেন ফিরে পেল না নাসিমা।
অতলে, আরো অতলে।
কম্পিত দুহাতে আয়নার পর্দাটা সে টেনে দিল তার প্রতিফলনের ওপরে।
.
দরোজার ওপরে দাঁড়িয়ে মুখ নিচু করে আবছা গলায় পারুল বলল, তাহলে তুমি সত্যি চলে যাচ্ছো।
নাসিমা তার খাটের ওপর সুটকেশ তুলে বই কাপড় গোছাচ্ছিল এতক্ষণ ধরে। কখন যে পারুল এসে দাঁড়িয়েছে সে বুঝতে পারে নি। তার কণ্ঠস্বরে মুখ ফিরিয়ে তাকাল।
পারুলের মুখটা কেমন ছায়া ছায়া হয়ে আছে।
এত কিশোরী তার মুখ যে দেখলে মমতা হয়। এখন সেই মুখ মেঘ ছায়া নিয়েছে। অস্পষ্ট হয়ে এসেছে মুখের রেখাগুলো। পারুল কি কেঁদে এসেছে কোনো নির্জন কোণ থেকে? নাসিমা এক মুহূর্ত তাকিয়ে দেখে দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নিল। ব্যস্ত হলো তার গোছানোর কাজে। পারুল যদি কাঁদতে চায় তাহলে তাকে কাঁদতে দেয়া ভালো। নাসিমা উত্তর করল, সত্যি করে বলার কী আছে? হা যাচ্ছি।
কিন্তু সহজ হতে পারল না নাসিমা। বিদ্ধ হয়ে রইলো পারুলের এই নীরবে দাঁড়িয়ে থাকা। পারুল, তুমি চলে যাও।
যে দ্রুততা ছিল তার দুহাতে এখন তা শিথিল হয়ে আসতে লাগল। এক সময়ে সে তাকিয়ে দেখল তার দুহাত স্তব্ধ হয়ে গেছে অনেক আগেই। আস্তে আস্তে সমুখের দিকে দৃষ্টি করল নাসিমা।
এই বিন্দু থেকে কামরার তিনটে কোণ চোখে পড়ে। এইতো তার নিজের খাট। সুন্দর করে চাদর বিছানো ছিল—-নিভাঁজ, সাদা, কোমল—- আজ সকাল অবধি। এখন তা ভাঁজ করে তুলে ফেলা হয়েছে। বোর্ডিংয়ের দেয়া পাতলা কাঠ–কাঠ তোষক বিশ্রী একটা শূন্যতার প্রতীক হয়ে পড়ে আছে বদলে।
আর ওই কোণে পারুলের বিছানাটা এখনো পাতা। সুন্দর করে পাতা। পারুল রঙিন চাদর পছন্দ করে। আজ দুপুরে যখন কামরা কেউ ছিল না তখন চুপি চুপি সে পারুলের বিছানাটা শেষবারের মত নিজ হাতে পেতে রেখেছে।