খাবো।
নাসিমার মন উন্মুখ হয়ে উঠল বেবির এই আদরটুকু দুহাত ভরে নেবার জন্যে। প্রশ্রয় দেবার আগ্রহে কোমল হয়ে এলো তার চোখ। আবার বলল, তোমার ভালো লাগে, না?
মাঝে মাঝে। এই লোকটা সাইকেল নিয়ে রোজ সন্ধ্যেয় এখানে দাঁড়ায়। সবাই চেনে। শুধু কি পটেটো চিপস? —- আরো কত কী। আমি কখনো কখনো কিনি।
লোকটা সাইকেলের ক্যারিয়ারে বাঁধা ট্রাঙ্ক থেকে চিপস ভরে ঠোঙ্গা এগিয়ে দেয়। প্রশ্ন করে, অওর দু?
ব্যস, আভি নহি।
বেবি দালানের দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। মুড়মুড় করে একটা দুটো চিপস দাঁতে কাটতে থাকে। সমুখে দাঁড়িয়ে নাসিমাও।
আরো নেবে?
নাহ্। চলো এগোই।
দূর থেকে চোখে পড়ে আঁধারে আবছা হয়ে আসা স্টেডিয়াম। তার কনস্ট্রাকশনের খাড়া লোহা অজস্র জটিলতা হয়ে আছে আকাশের গায়ে যে আকাশ থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে এখনো। রক্তিম একটা আভা। সব মিলিয়ে খানিকটা মোবাইল স্কাল্পচারের মত লাগে স্টেডিয়ামকে। গভীরে কোথাও কান পাতলে প্রাণস্পন্দন শোনা যাবে যেন।
বেবিকে নিয়ে নালিমা নির্জন স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে এসে দাঁড়াল। সিঁড়ি বেয়ে উঠলো ওপরে, আরো ওপরে, বাঁধানো চওড়া চত্বরে।
কেউ নেই। এ মাথা থেকে দৃষ্টি করলে সবচে দূরের বিন্দুটি চোখে পড়ে না। হাঁটতে হাঁটতে ওরা একেবারে ওদিকটায় গিয়ে পড়ল—- ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট বিল্ডিংয়ের চুড়োয় লাল তারার কাছাকাছি। দূর থেকে সমস্ত শহরের কোলাহল ঢেউয়ের মত কাঁপন তুলে মৃদু থেকে মৃদুতর হয়ে আছড়ে পড়ছে এই সীমানায়। এত দূরে আমি এসে গেছি। চিরকাল এমনি একটা সুদূরে পৌঁছুনোর চেষ্টা চলছিল বুঝি আমার। পায়ের নিচে সিমেন্টের রুক্ষ স্পর্শ নাসিমা অনুভব করতে থাকে স্যাণ্ডেল থেকে পদতল নগ্ন করে। আবার তারা হাঁটতে হাঁটতে প্রথম বিন্দুতে এসে পৌঁছোয়।
আস্তে আস্তে শহরটা যেন কাছে চলে আসে। যেন তারা দুজনে স্থির, ঘুরছে তাদের চারপাশে এই দিকের আলো–মানুষ আর ওদিকের আঁধার–নির্জনতা। লাল তারাটা ছোট থেকে বড় হয়ে আবার ছোট হয়ে যায়।
দূর থেকে বেশ দেখায়, না?
কী?
তারাটা।
হ্যাঁ।
আমার হৃদয় এমনি রক্তাক্ত। নাসিমা দূরে সরে যেতে যেতে লাল তারা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে। নিচে মাঠের দিকে তাকায়। কয়েককটা লোক স্থির হয়ে বসে আছে। ওপর থেকে দেখাচ্ছে কালো পাথরের টুকরোর মত। আমিও কি ওখানে নেমে গেলে বেবির চোখে অমনি পাথর হয়ে যাবো? কালো পাথর?
দূরে সরে যাওয়ার ফলে বেবির চোখ থেকে নাসিমার মুখ অদৃশ্য হয়ে যায়। শুধু সাদা শাড়ি একটা রঙের পোচের মত আকাশের পটভূমিতে স্থির হয়ে থাকে। বেবির ভালো লাগে এই সাদা রঙটা থেকে এমনি দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে। অদ্ভুত, এমন কী অকারণ একটা কৃতজ্ঞতায় মন ভরে ওঠে তার নাসিমার জন্যে। মনে মনে বলে, আমার কী যে ভালো লাগছে তোমার সঙ্গ পেয়ে তুমি তা জানবে না। আমি তোমার কাছে কিছুই চাই না। আমাকে তুমি নাড়া দাও, ঝড়ের দোলায় অস্থির করে তোলো আমার আর কোনো বাসনা নেই। আমাকে প্রশ্ন করো, লক্ষ লক্ষ অযুত প্রশ্ন।
নাসিমাই প্রশ্ন করল। কী ভাবছিলে?
কই কিছু না।
আমাকে বলতে তোমার ভয় করে?
নাসিমার ইচ্ছে হয় দুহাত দিয়ে ধরে রাখে বেবির সুন্দর এখনো সবুজ মুখ। কোনদিন যেন তাকে হারাতে না হয় এমনি প্রার্থনায় কাঁপতে থাকে তার আত্মা। মমতায় নত হয়ে আসে নাসিমা। বলে, কেউ চুপ করে থাকলে আমার খারাপ লাগে। কেন? তুমি চুপ করে থাকলে আমার আরো খারাপ লাগে।
তখন বেবি ফস্ করে শুধোয়, তোমাকে কী বলে ডাকব?
আজ সন্ধ্যে থেকে এই সমস্যাটা তাকে পীড়িত করছিল।
বেবি গভীর প্রায় অসহায় একজোড়া চোখ মেলে তাকায় তার দিকে। নাসিমার ঠোঁট তখন নিঃশব্দ হাসির কাঁপনে ফুলে ওঠে। নাসিমা হাসে। বলে, ওই পোস্টের কাছে বসিগে চলো। বেবি তখন একটা নিদারুণ লজ্জার হাত থেকে বেঁচে যায়।
নাসিমা তার কাঁধে হাত রেখে বসে।
কাদা তোমাকে স্পর্শ করেনি, তুমি কোনোদিন কাদায় নেবে যেও না।
নাসিমা মনে মনে অনেকক্ষণ প্রার্থনা করলো বেবির জন্যে।
বেবিকে আমি ভালোবেসেছি, যেমন করে আকাশ ভালোবাসে প্রান্তরের একেলা গাছটিকে। যেমন করে পাখি তার সন্ধ্যেয় ফিরে আসে বাসাতে, তেমনি কি তুমিও ফিরে আসতে পারো না?
নাসিমার নিজেকে মনে হলো একটা শুকিয়ে ম্লান হয়ে যাওয়া বৃক্ষশাখা। বিশ্রাম কেউ নিতে পারে হয়ত, কিন্তু বাসা? বাসা কেউ বাঁধবে না।
নাসিমা বেবির চুলে যখন হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল তখন বেবির মন যেন অনর্গল একটা স্রোতধারা হয়ে উঠেছিল।
নাসিমা তার কানে কানে মুখ রেখে বলল, তোমাকে আমার এত আপন, এত ছোট মনে হয়। কথা দাও আমাকে তুমি কষ্ট দেবে না?
বেবি কিছুটা বিস্মিত হলো কিন্তু মুখে বলল না কিছু।
তখন নাসিমা বলল, আমি তোমার মা হতে চাই, বেবি। আমি তোমার মা।
বলতে বলতে উদ্বেগ যেন স্বেদ বিন্দুতে রূপান্তরিত হয়ে কাঁপতে লাগল নাসিমার কানের পিঠে, আর চিবুকে, আর কপালের ওপরে। বেবি তখন সমস্ত শরীরটাকে শিথিল করে দিল। কিছু বলল না। নাসিমা তাকে বুকের ভেতরে টেনে অসংলগ্ন কণ্ঠে উচ্চারণ করল, এখানে, এখানে।
তারপর মাতাল–প্রায় কণ্ঠে বারবার
—-বেবি, বেবি, বেবি। তুমি আমার, বেবি।
যেন নিজের ওপরে আর কোনো কর্তৃত্ত্ব নেই বেবির। আঙ্গুলের ডগা দিয়ে সবকিছু একটা শীতলধারা হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তার মনে হলো পৃথিবীর বাইরে সে চলে গেছে। কোনো কিছু দিয়েই আর সে এই অবস্থার পরিমাপ করতে পারবে না। বদলে, নাসিমা একটা প্রখর শক্তির জন্ম অনুভব করতে পারে নিজের ভেতরে।