রিকশা থেকে নেবে বেবি পয়সা দিতে গেল কিন্তু নাসিমার জন্য সম্ভব হলো না। খুচরো পয়সা ফিরিয়ে নিতে নিতে তরলকণ্ঠে বলল, খুব বড়লোক হয়েছ, না? বাড়ি থেকে বুঝি পাঁচশ টাকা করে অ্যালাউন্স দিচ্ছে?
তবে কী!
বেবিও কৌতুকে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। পরে যোগ করে, বাঁচালে আমাকে।
বাসা থেকে বেরুবার সময় অনেক খুঁজে–পেতে বেবি পনেরো টাকা পকেটে নিয়ে বেরিয়েছিল।
নাসিমা আচমকা প্রশ্ন করে, তুমি সিগারেট খাও, না?
কেন? মানে খাই তো।
ডেঁপো কোথাকার। আমার সমুখে বলতে লজ্জাও করলো না? আছে? না, কিনতে হবে? না থাকলে কিনে নাও।
বলতে বলতে নাসিমা ব্যাগ থেকে টাকা বার করলো।
.
বেবির সিগারেট ধরানো অনভ্যস্ত ভঙ্গিটি লক্ষ্য করে নাসিমা না হেসে পারলো না। বেবি ফস করে ঠোঁট থেকে সিগারেট নাবিয়ে শুধালো, হাসলে যে?
কদ্দিন হলো সিগারেট খাচ্ছো শুনি?
কেন?
শুধোচ্ছি।
বেবি তখন ভারী লজ্জা পেয়ে গেল। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে দূরে সাইন আলোর দিকে। তাকিয়ে উত্তর করল, আগে খেতাম না। এই ইউনিভার্সিটিতে উঠে।
তাই বলো।
নাসিমার কণ্ঠের স্বচ্ছতা বেবিকে এমন করে স্পর্শ করে যে তখন তার মনে হয় সে একেবারে এতটুকু হয়ে গেছে। নিজেকে জোর করে দুপায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে রাখবার চেষ্টাটা কেমন ব্যর্থ হয়ে যেতে থাকে। এমন কি খুব অস্পষ্ট করে একটা অভিমান গড়ে উঠতে থাকে তার বুকের ভেতরে। কিন্তু নাসিমার পরের কথা তার শ্রুতিতে এসে কাঁপন তোলার সঙ্গে সঙ্গে মনটা আবার প্রসন্ন হয়ে যায়।
নাসিমা বলছে, রাগ করলে নাকি?
না—-না।
ওরা তখন হাঁটতে থাকে রমনা পোস্টাফিসের সমুখ দিয়ে। কেমন আঁধার আঁধার, আর তারি ফাঁকে ফাঁকে মানুষ, টাঙ্গাইল যাবার বাস আর টিমটিমে লালচে আলো ফেরিদোকান থেকে। দীর্ঘ বাসগুলো যেন একেকটা অনুভূতির মত স্তব্ধ হয়ে আছে। তাদের হলুদ রঙ মৃতের মত পাণ্ডুর দেখাচ্ছে। আর গাছ। আর শাদা মসজিদটা শাদা।
নাসিমা বেবির ডান হাত তুলে নেয়। আঙুলে আঙুল ছুঁইয়ে হাঁটতে থাকে। আঙুলের উষ্ণ স্পর্শে নাসিমা নিশ্চিন্ত হতে পেরেছে, সে এই পৃথিবীর কঠিন মাটিতে দাঁড়িয়ে আছে। আছে, শুধু আছে এই বোধ তার এত প্রয়োজন।
আস্তে আস্তে আলোয় এসে পড়ে ওরা। একটা স্বচ্ছন্দ স্রোতোধারায় অনায়াসে যেন তারা প্রবাহিত হয়ে যাচ্ছে।
এই মুহূর্ত যে কত পবিত্র তা পৃথিবীর কেউ জানব না। নাসিমার মনে হয় জীবনে সমস্ত থুতু আর কাদার সাম্রাজ্য থেকে তার শুভনির্বাসন ঘটেছে। সে মুক্ত। অনুরাগে তার মন গান হয়ে উঠতে চাইলো।
বাঁদিকের ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে স্টেডিয়ামের দিকে মোড় নিল ওরা। এখানটায় এত আলো, এত কণ্ঠ যে নাসিমার মন বিশুদ্ধ রকমে চঞ্চল হয়ে ওঠে। বলে, বেবি, রোজ আমি এখানে আসব।
বেশতো। আমিও থাকবো।
থাকবে, থাকবে বৈকি।
সমুখে জুতোর দোকান পড়ল। বেবি দাঁড়িয়ে বলল, দাঁড়াও।
কেন? জুতো কিনবে?
না, এমনি। দেখব। শো কেসে দাঁড়িয়ে জুতো দেখতে তোমার ভালো লাগে না? আমার লাগে।
অদ্ভুত তোমার শখ।
কিন্তু নাসিমাও তার সঙ্গে সঙ্গে অনেকক্ষণ দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে।
তোমার কোনটা পছন্দ? এইটে?
দূর—-এত শৌখিন যে মনে হয় গালে বুলোবার জন্যে।
বলেই হেসে ফেলে।
তাহলে ওটা?
হ্যাঁ, ওটা, ওটা ভালো। কিনছ নাকি?
দেখছি।
কিনবে তো চলো না?
বলে নাসিমা একটু আমতা আমতা করে। বেবি, আমাকে তুমি বলতে পারো না? আমার কাছে চাইতে পারো না? একটা ব্যথা অনুভব করে নাসিমা। কেমন বিচ্ছিন্ন অসহায় মনে হয় নিজেকে।
যোগ করে, —-আমার কাছে কিন্তু টাকা আছে।
না, থাক।
তখন নাসিমা দ্বিগুণ মনোযোগ দিয়ে জুতো দেখতে থাকে সাজানো শো কেসে। আস্তে আস্তে তার মনে হতে থাকে কার্নিভালের নাগরদোলার মত জুতোগুলো যেন একটা বৃত্তপথ ধরে ঘুরছে—-উঠছে, নামছে। আবার উঠছে। খুব আস্তে, এত আস্তে যে চোখে দেখা যায় না রক্ত দিয়ে অনুভব করতে হয়। রক্তের ভেতর দোলা অনুভব করে নাসিমা আখতার। স্থির, আরো স্থির। দ্রুত, আরো দ্রুত। হঠাৎ এক সমযে চাবি ছেড়ে দেয়া স্প্রিংয়ের মত মুহূর্তে তার ভাবনার টানটান সরলরেখা শিথিল হয়ে আসে, ঝুলতে থাকে হাওয়ায় গুড়া শুকনো লতার মত। তখন জন্ম হয় নতুন ছবির। মনে হয়, জুতোগুলো এখন অই শোকেসে সাজানো আছে কারিগরের যন্ত্রে বানানো একটা নৈর্ব্যক্তিক চেহারা নিয়ে, মাপ নিয়ে। তারপর কেউ হয়ত তাকে কিনবে, আস্তে আস্তে তার পায়ের প্রতিরূপ সৃষ্টি হবে জুতোর শরীরে। তখন আর ঐ চেহারাটা থাকবে না, তখন হবে তার একমাত্র তার পৃথিবীর আর কারো নয়। তখন এই জুতোজোড়াকে আলাদা করে চেনা যাবে না।
কিন্তু কেন আমি ভাবলাম এ কথা? কতক্ষণ ধরে ভাবছিলাম? বেবি তখনো জুতো দেখছে—-এবারে মেয়েদের শো কেস। নাসিমা তাকে আড়চোখে দেখে নিল পলকে।—-এমনি করেই কি আমরা সবকিছুকে বদলে দিই? আরোপ করি আমাকে? আমার সৃষ্টি তুমি, আর তুমিও, আর এমন কি তুমিও। আমি যদি তোমাকে সৃষ্টি না করতাম তাহলে তুমি হতে। জন্মহীন একটা কুয়াশা মাত্র। আমার রূপ তোমাতে বলেই তুমি বাঁচো।
আমি তোমাকে আমার সুন্দর তৃষ্ণা দিয়ে সৃষ্টি করব, বেবি।
বেবি।
কী?
চলো যাই।
কোথায়?
মনে মনে কষ্ট ছড়িয়ে পড়ল নাসিমার।
আমি প্রশ্ন বুঝতে পারি না। যেখানে খুশি। বলেছি না, আমাকে তুমি শহর দেখাবে।
৩. একটা অন্ধকার পথ পড়ল
কয়েকগজ এগোতেই বামে একটা অন্ধকার পথ পড়ল। দুদিকে উঁচু দালান—- মাঝখান দিয়ে কুয়াশা অন্ধকার একটা খোলা জায়গায় পড়েছে, তার ওপারে আরেকটা পথ বাহুর মত পড়ে আছে। দুদালানের মাঝখানে এসে বেবি বলল, এসো এদিকে। চিপস খাবে? পটেটো চিপস?