.
বেবি যখন এলো তখন ছটা বেজেছে। আর আকাশের পশ্চিমে নিবিড় একটা অন্ধকার ভায়োলেট হয়ে নেবে আসছে আস্তে আস্তে। তার পদপাত অনেকটা বেবির মত। প্রায় বোঝ। যায় না, কিন্তু অস্থির, একমুখী।
বেবি এসে বলল, দেরি করে ফেলোম। অনেকক্ষণ বসেছিলে?
ছিলাম। দেরি হলো কেন? তোমার জন্যে এখন অবধি চা খাইনি আমি।
বেবি একটু অপ্রতিভ হলো।
আর দেরি করবো না।
কোরো না। কক্ষনো কোরো না। কেউ বসে থাকলে তার কষ্ট হয় না?
হঠাৎ নাসিমা হেসে ফেলে—-ইস, আজ তোমাকে খুব করে বকতে ইচ্ছে করছে।
কেন?
কেন আবার? মানুষ বকে কেন? দোষ পেলেই বকে।
বেবি বাতাসের কাঁপনের মত মৃদু মৃদু হাসে। তার যেন কোনো সত্যি সত্যি ভয় নেই নাসিমার কাছ থেকে এখন, এই কথাটা বুঝতে পেরে দুহাতের তালু বাজাতে থাকে অস্পষ্ট করে। নাসিমা বলে, মতির মা চা নিয়ে আসুক, কেমন? না কি ঘরে খাবে?
ঘরের প্রসঙ্গে উঠতেই বেবির আগ্রহ যেন বিবর্ণ হয়ে যায়—-কেননা, বেবি যে আরজুর। স্বামীর ছাত্র ইউনিভার্সিটিতে, এই কথাটা মনে পড়ে গেছে হঠাৎ। কী একটা অপরাধবোধ সচকিত হয়ে ওঠে ভাবনায়। বলে, না, বারান্দাতেই ভালো। কী বলে?
যা বলো তুমি।
মতির মা চা আর নাশতা এনে রাখলো। নাসিমা ফেরার পথে কিছু শাদা সুগন্ধ ফুল মুঠো করে এনে বেবির হাতে দিল।
পকেটে রেখো। বাসায় ফিরে আমার কথা মনে পড়বে।
বেবি বলে নাকের কাছে ছুঁইয়ে, বেশ ঘ্রাণ। বলতে বলতে ওপর পকেটে রেখে দেয়। যোগ করে, আমার টেবিলে রাখবো।
তারপর দুজনে মুখোমুখি বসে চা খেতে থাকে।
চা খেয়ে বেরোয়।
প্রীতিতে মন আচ্ছন্ন হয়ে আসে নাসিমার। এতক্ষণ ধরে আরজুর আয়নার নগ্নতা আর শরীরের নামহীন সেই অস্বস্তিটা তাকে দগ্ধে দগ্ধে মারছিল। বাইরে বেরুবার সঙ্গে সঙ্গে তার আর চিহ্নমাত্র রইলো না।
রিকশার দোলায় বেবির শরীর ছুঁই ছুঁই হয় নাসিমার সঙ্গে। বেবি সঙ্কুচিত হয়ে এতটুকু হয়ে যায় যেন। মধুর লাগে নাসিমার। মুখে বলে, এত লাজুক তুমি!
কই না?
বদলে বেবি আরো সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে, রক্তিমাভা ছড়ায় সারা মুখে। অন্ধকারে ভালো করে দেখা যায় না। কিন্তু নাসিমা জানে ওর মুখ এখন করতলের মত বক্তিম হয়ে উঠেছে। আরো একবার তার নাম ধরে ডাকে নাসিমা, বেবি, বেবি।
প্রায় ফিসফিস তার কণ্ঠস্বর।
কী, বলো না? বলবে কিছু?
না, এমনি।
বেবি আবার হাসলো। তেমনি কাঁপন তোলা ওর পুরনো মৃদু মৃদু হাসি। এক মুহূর্তের জন্যে নাসিমার ভালো লেগেছিল তার নাম ধরে ডাকতে নাম উচ্চারণের ভেতর দিয়ে এই নাম যার তাকে নিশ্চয় করে অনুভব করতে। হঠাৎ এক ঝলক তীব্রতার মতো নাসিমার মনে দ্রুত প্রবাহিত হয়ে গেল একটা অন্ধকার যে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আকাশের অনেক শূন্যতা থেকে কে যেন বলেছিল, ইজ দ্যাট ডাউন দেয়ার হোয়ার উই গো?
ইয়েস, ইয়েস।
মনের ভাবনাটা কখন অস্পষ্ট উচ্চারণ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে। বেবি উন্মুখ হয়ে তাকাল তার দিকে। বলল, কী?
এই অতল অন্ধকারে কি আমার যাত্রার শেষবিন্দু? না, আমি তো কিছু বলিনি। ইয়েস, ইয়েস। বেবি, আমি কিছু বলিনি তোমাকে কিছুই বলিনি।
তবু কেন এমন হবে আমার কণ্ঠের ওপর থাকবে না আমার কোনো শাসন? কেন আমার ভাবনাগুলো আপনা থেকেই বেছে নেবে বাইরে বেরুবার শরীর? উচ্চারিত হবে?
নাসিমা এইসব ভাবলো বেবির ছোট্ট প্রশ্নের পর। ব্ৰিত, ক্ষুদ্র বোধ করল নিজেকে। বলল, ঢাকায় এই প্রথম এলাম আমি।
জানি।
তোমাকে নিয়ে বেরুলাম শহরটা চিনবো বলে—- আর তুমি কিনা চুপ করে রইলে?
কই?
কথা বলো। এত অন্ধকার কেন, বেবি? আলো নেই, মানুষ নেই, একী রকম শহর?
এত বিনষ্ট মনে হলো শহরটাকে নাসিমার, রিকশা থেকে বাইরে দৃষ্টি করে বুকের ভেতর সে একটা দম আটকানো ব্যথা অনুভব করল। কেমন বিচ্ছিন্ন, উদ্বেগহীন, কম্পিত এই শহর। একটা কালির ফোঁটাকে মাইক্রোস্কোপের ভেতর দিয়ে দেখলে যেমন—-ইজ দ্যাট ডাউন দেয়ার? ওখানে? ওখানেই কি? আমি জানি না, নাসিমা ভাবলো; নাসিমা আরো ভাবলো, অথচ এখানেই।
বেবি বলল, এই পথটা আগে এত সরু ছিল! এখন যা দেখছ ঠিক তার আদ্ধেক। আর দুধারে পঞ্চাশ পাওয়ারের বাল্ব জ্বলা সব দোকান। উনিশ শপঞ্চাশের পর এইসব হয়েছে। আরো হবে।
তাই নাকি?
শহরটা বাড়ছে। এত তাড়াতাড়ি বাড়ছে যে, সাতদিন আগে কোথায় কী ছিল মনে রাখা যায় না। এখানে, হ্যাঁ এখানেই হবে, সেই গাছটা ছিল—-একটা সিগারেটের দোকান, ওইখানে মাঠ আর ওধারে বোধহয় সিনেমা হলটা। কী জানি, ঠিক মনে পড়ছে না।
নাসিমা চোখ বুজঁলো। ভাবনাগুলো চোখের পাতার মতো নিঃশব্দে নেবে এলো। আমিও আর কিছু মনে রাখতে চাই না। কোনো স্মৃতি. কোনো সঞ্চয়, কিছু না। শুধু আমার শরীরে দাগ দেখে কেউ হয়ত কোনদিন মনে করতে চেষ্টা করবে– না!
আবার ফিরে এলো। আনিস, জওয়াদ, লাবু চা বাগান। ওরা কারা? হামেদ আমাকে বিশাল করে দিয়ে গেছে।
আনিস বলেছিল, আকাশের মত আমার মুখ। আমি কি অপূর্ণ থাকব? করাচির অপারেশন টেবিলে কি আমার শেষ মৃত্যু হয়ে গেছে? বেবি পাশে বসে উসখুস করেছিল, সেটা হঠাৎ চোখে পড়ল নাসিমার।
কিছু বলবে?
কোথায় যাবে তাই শুধোচ্ছিলাম।
কোথাও না। এমনি।
মনে মনে বলল, আমার নতুন জন্ম, নতুন শহর। তুমি আমার আনন্দ, তুমি আমার সুন্দর। মুখে হঠাৎ চঞ্চল হয়ে বলল, চল, এখানেই নেবে পড়ি। হাঁটব আজকে।