অন্যদিকে ইতস্তত দৃষ্টি করছিল আবু। এখন যেন মনে হচ্ছে, বিলকিসের কাছে তার পৌঁছুতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। চোখ ফিরিয়ে তাড়াতাড়ি বলল, না, না।
খাও না কিছু।
কামাল তার হাতে ঠেলা দিয়ে কথাটা বলল; বড়ড ভালগার মনে হলো তখন তাকে। আবারো শুধালো, চপ?
না।
কাটলেট?
না।
তো কী খাবে?
আবু যাবার জন্যে অস্থির হয়ে উঠল। কিছু বুঝতে না পেরে কামালেরই খোলা প্যাকেট থেকে সিগারেট নিয়ে ধরালো। সিগারেট সে বড় একটা খায় না। এখন মনে হচ্ছে এর চেয়ে ভালো কিছু নেই। এতে করে দুরন্ত আঙুলগুলো তবু ঠাণ্ডা থাকছে। কামাল আবার জিগ্যেস করল, কেক? পেশট্রি?
বললাম তো শুধু চা। তা নয়, তুমি একেবারে পুরো মেনু মুখস্ত বলতে লেগেছ।
তার কথা শুনে হা হা করে হাসল কামাল। হাসতে গিয়ে তার রোগা মুখটার অনুপাতে অসম্ভব বড় একটা হাঁ সৃষ্টি হলো। বলল, না হয় বিজনেসে লসই খাচ্ছি, তাই বলে বন্ধু বান্ধবকে খুশি করবার মতো অবস্থা নেই? এই দ্যাখোনা, জুন থেকে ডিসেম্বর, পাকা ছটি মাস— আবু বাধা দিল।
কামাল, এক্ষুনি যেতে হবে এক জায়গায়। একেবারে ভুলে গেছি। খুব দরকার।
বলতে বলতে উঠে দাঁড়াল আবু। কামালকে এক লহমার সুযোগ দিল না। নইলে ঝাড়া দুঘণ্টা তার বকবকানি শুনতে হতো।
একেবারে মনেই ছিল না। আরেকদিন তোমার চা পেশট্রি চপ কাটলেট যা আছে সব খাওয়া যাবে। চলি।
বাইরে বেরিয়ে আবু যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে। বেরিয়ে আসবার মুখে জোর করে হাসতেও হয়েছিল একবার। বাইরে এসে হঠাৎ সে অনুভব করে পেশীতে হাসিটা তখনো আঁকড়ে আছে।
বিরক্ত হয়ে মুহূর্তে সেটাকে নিশ্চিহ্ন করে আবু রিকশা নেয়।
বিলকিসদের বাসায় যখন পৌঁছুলো তখন প্রায় সাড়ে চারটে। মাত্র আধঘণ্টা। দেরিটা এখনো ভদ্রতার সীমারেখা পেরিয়ে যায়নি দেখে আবু মনে মনে খুশিই হলো।
একবার ইতস্তত করল গেটের কাছে দাঁড়িয়ে। নীল বার্ণিশ করা কাঠের দরোজা। হঠাৎ মনের মধ্যে ভীষণ একটা টান অনুভব করল আবু। ফিরে যাবে? যেন দেখা না হলেই পরম একটা স্বস্তি পাওয়া যাবে, কিন্তু ফিরে যাওয়াও যায় না আর। কেউ দেখলে বলবে কী, লোকটা দরোজার কাছে দাঁড়িয়ে না ডেকেই চলে যাচ্ছে। কত কী ভাবতে পারে ঐ তো মোড়ে দাঁড়ানো লোকটাই। কিংবা বিলকিস যদি দেখে ফেলে দোতলা থেকে?
প্রায় সংগে সংগে বছর দশেকের একটা মেয়ে দৌড়ে এসে দরোজা খুলে প্রজাপতির মতো জিগ্যেস করল, কাকে চান?
আন্দাজ করে আবু বলল, তোমার আপাকে।
মেয়েটি শরীর দুলিয়ে বলল, নেই তো। আপনার একটা চিঠি আছে। এখন চারটে বাজে না?
হ্যাঁ।
আবুর মাথার মধ্যে সব যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। বোকার মতো সে জিগ্যেস করল, নেই?
উহু। বাইরে গেছে। দাঁড়ান, যাবেন না।
চিঠি এনে দিল মেয়েটি। সে চিঠিতে লেখা আছে—-
আপনাদের বাসা থেকে কে একজন এসে ইউনিভার্সিটিতে খুঁজছিল আপনাকে। তক্ষুণি যেতে বলেছিল। বাসায় কে যেন এসেছেন বলল। নামটা মনে করতে পারছি না। বারবার বলে গেছে দেরি করবেন না যেন। ভালোই হলো, আমাকেও হঠাৎ একটা দরকারে বেরুতে হতো। তাতে না জমত আলাপ, মাঝ থেকে শুধু শুধু কষ্ট করতেন। কিছু মনে করবেন না। আরেক দিন আসবেন?
এক মুহূর্ত কি ভাবল আবু। চিঠিটার মর্ম ভালো করে বুঝলোও না। আগাগোড়াই যেন বিলকিসের ব্যঙ্গ–তাকে ডাকা, ডেকে না থাকা। হঠাৎ মরিয়া হয়ে উঠল সে। খাতা খুলে লিখল—- আমি না এলে কারো কিছু এসে যাবে না আশা করি। আরেকটা তারিখ নাইবা নিলেন।
পাতাটা ছিঁড়ে ভাঁজ করে মেয়েটোকে দিয়ে বলল, তোমার আপাকে চিঠিটা দিও।
৩. ডাক্তার এসে চলে গেছে
ডাক্তার এসে চলে গেছে। বাবা এসেছেন, বড় চাচা এসেছেন, আবু এসেছে সবাই এসেছে। মাহবুব জরুরি কাজে ব্যস্ত, পরে আসবে জানিয়েছে। যেন হাট লেগেছে আজ মরিয়মের বাড়িতে।
কিন্তু হাশেমকে কি সুস্থির রাখা যায়?
থেকে থেকেই বিছানা ছেড়ে দাঁড়াচ্ছে। কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে রক্তচোখে লম্বা লম্বা পা ফেলে পায়চারি করছে। তার রকম দেখে না কাছে আসা যায়, না কিছু বলা যায়।
বিছানায় কি সহজে আসতে চেয়েছিল? সেই বাইরের ঘরেই গো ধরে বসে থাকবে। কেউ তাকে একচুল নড়াতে পারেনি। ইতিমধ্যে জ্বরের ঘোরে একবার অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল, সেই তখন ধরাধরি করে নিয়ে আসা হয়েছিল ওপরের ঘরে।
জ্ঞান ফিরেছে মাত্র কিছুক্ষণ আগে। সাহস করে বড় চাচা খোরশেদ চৌধুরী স্মিত মুখে এগিয়ে আসেন। হাশেম তার দিকে দৃষ্টিবাণ হানে, যেন এই লোকটাকে চিনতে খুব কষ্ট হচ্ছে তার। কিছুতেই মনে পড়ছে না কোথায় দেখেছে। খোরশেদ চৌধুরী বললেন, তোমরা সবাই যাও তো এ ঘর থেকে। দেখি আমি ওকে বোঝাতে পারি কি না।
তারপর হাশেমের কাঁধে হাত রেখে ডাকলেন, এসো।
কী হলো হাশেমের, মন্ত্রমুগ্ধের মতো অনুসরণ করল তাঁকে। গিয়ে সুবোধ ছেলের মতো বিছানায় শুয়ে পড়ল।
খুব কষ্ট হচ্ছে, বাবা?
না। নাতো।
আমাকে চিনতে পারছিস?
হুঁ।
কে আমি বলতো?
বড় চাচা। ছেলেমানুষের মতো টান তুলে উচ্চারণ করে হাশেম। শুনে সবাই অবাক হয়ে যায়। যাকে কিছুতেই ধরে রাখা যাচ্ছিল না, সে হঠাৎ এত শান্ত হয়ে গেল কী করে?
খোরশেদ চৌধুরী তখন হাশেমের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, একটু চুপ করে থাকো। কেমন? নইলে সেরে উঠবে কী করে?
হাশেম তক্ষুনি চোখ বুজে তাঁর কথা পালন করলো।