- বইয়ের নামঃ অচেনা
- লেখকের নামঃ সৈয়দ শামসুল হক
- প্রকাশনাঃ আলোঘর প্রকাশনা
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
০১. সারারাত যেন ঘুম আসে না আনুর
সারারাত যেন ঘুম আসে না আনুর। ট্রেন কখন মহিমপুর পৌঁছুবে সেই ভাবনা তার। হুট করে স্টেশন আসে, ঘুরঘুটি অন্ধকারের মধ্যে প্ল্যাটফরমে ভূতের মতো মানুষগুলোকে ছুটোছুটি করতে দেখা যায়। একটা টেমি হাতে কে ডাকতে ডাকতে চলে যায়– চাচা, চাচাগো, কোথা থেকে যেন খট খট ঘটাং ঘটাং শব্দ উঠতে থাকে, আনু জিগ্যেস করে–হ্যাঁ বাবা এসে গেছি আমরা?
আরে না। তোর ঘুম নেই লক্ষ্মীছাড়া। ঘুমো।
কিন্তু আনু ভয় পায় না। বাবা অমন ধমক দিলেও সে শুয়ে পড়ে না। জানে বাবা ঐ রকমই, তাকে কিস্সু বলবেন না। সান্তাহারে তিনঘণ্টা বসে থাকবার পর যখন গাড়ি এলো, বাবা বলেছিলেন, এইবার আমরা এসে গেছি। সেই কথাটা শুনে অবধি আনুর ঘুম গেছে। নইলে তার আগে চমৎকার ঘুমোচ্ছিল সে মার পাশে ওয়েটিং রুমের বেঞ্চিতে। শোবার আগে বাবা মিষ্টি কিনে এনেছিলেন এক হাঁড়ি। দুটোর বেশি খেতে পারে নি।
ট্রেনে কিস্সু খেতে পারে না আনু। বাবার সঙ্গে কত জায়গায় ঘুরেছে সে। বাবার শুধু বদলির চাকরি। বদলিটা খুব পছন্দ আনুর, কেবল চাকরিটা একেবারেই ভালো লাগে না। কত ছেলের বাবা ডাক্তার, উকিল, সার্কল অফিসার, কত কী!–আর কেবল তার বাবাই কোথা থেকে বেছে বেছে দারোগা হয়েছেন। ছেলেরা ঠাট্টা করে; বলে–দারোগার ব্যাটা, পালা পালা, ধরে হাজতে নিয়ে যাবে। আনুব তখন জেদ হয় খুব। একেকবার ছেলেগুলোকে ধাওয়া করে; যেন সত্যি সত্যি ধরবে। কিন্তু একি; সবাই ভয় পাওয়া দূরে থাক, একটু দৌড়ে গিয়েই খিলখিল করে হাসতে থাকে। তখন আনু বুঝতে পারে, তার কোনো জোর নেই, কিছু নেই। সে একা।
একেকদিন বাড়িতে এসে ধুপধাপ করে এটা ফেলে, ওটা সরায়, পরে মার কাছে গিয়ে বলে মা, তুমি বাবাকে আর থানায় যেতে দিও না।
কেন রে?
মা অবাক হয়ে জিগ্যেস করেন কাঁধ থেকে ধোয়া ভিজে কাপড়গুলো তারে মেলে দিতে দিতে। একটা কাক খা-খা করতে থাকে রান্নাঘরের চালে বসে। পর মুহূর্তেই মা ভ্রূকুটি করে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন কাকটা। তিনি বোধহয় আনুর অবাক-করা কথাটা ভুলেই যান। আনু তখন হাতের কঞ্চিটা দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে বলে, হ্যাঁ মা দিও না। ডাক্তার সাহেবের বৌ বলে, দারোগার ছেলে খারাপ। লাট্টুকে আমার সঙ্গে মিশতে না করে দিয়েছে।
মা-র হাতটা থেমে যায়। একটু চুপ করে থাকেন তিনি। আনুর দিকে তাকিয়ে দেখেন। তারপর হেসে ফেলেন। তখন আনুর রাগ হয় খুব। বলে, না আমি শুনবো না। লাট্টুর মা বলে কেন?
বলুক গে তুই আর যাসনে। নে, কাপড়টা ধর।
আনু একগাদা কাপড় কোলে করে দাঁড়িয়ে থাকে। তখনও ঘ্যানঘ্যান করে, তুমি বাবাকে বলো কিন্তু মা। কত ছেলের বাবা কত ভালো চাকরি করে।
কিন্তু বদলিটা পছন্দ। কত দেশ দেখা যায়। ইস, কত জায়গায় গেছে আনু। একেকদিন ছেলেদের মধ্যে তার খাতির হয়ে যায় ভারী। তাদের সে গল্প শোনায়। নিজেকে বড় বাহাদুর মনে হয় তার। রেললাইনের পাশ দিয়ে আসবার সময় সে হয়তো ভয়ে ভয়ে বলেছে—-এই জঙ্গলে ভাই বাঘ থাকতে পারে। তখন আনু সগর্বে ঘোষণা করে, বাঘ এলে রেললাইন দিয়ে আমি দৌড়ুবো। একেবারে চলে যাবো নাটোর; আবার দৌড়ুবো, আবার রাজশাহী, আবার দৌড়ে দৌড়ে আদমদিঘী চলে আসবো—-বাঘ আমাকে ধরতেই পারবে না।
ছেলেরা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। এক দৌড়ে যে এখান থেকে রাজশাহী যাওয়া যায় না, এখান থেকে অনেক দূর—- তা কারো খেয়াল হয় না। যেন সত্যি সত্যি আনু তা পারবে। তাদের চোখের সামনে ছায়াবাজির মতো অস্পষ্ট একেকটা শহরের ছবি ভেসে ওঠে। জলজলে রোদ, ঝিমঝিম দুপুর তারা কল্পনায় দেখতে পায়। বুনো পাখি ডাকছে করর ঠক্ করর ঠক্, গরুর গাড়ি যাচ্ছে ক্যাঁচ-ক্যাঁচ-ক্যাঁচ-ক্যাঁচ করতে করতে, কাঁচামিঠে আম ধরেছে বড় বড়—- আনুকে তাদের অন্যজগতের মানুষ মনে হয়।
আবার আরেকদিন হয়ত বিকেলে ঝিমিয়ে থাকা রেলস্টেশনে ওরা খেলতে আসে। সারা স্টেশন ফাঁকা। মিষ্টির দোকানগুলোর ঝাঁপ বন্ধ। গাড়ি একটা আসবে সেই রাত দশটায়। গুদামের পাশে কয়েকটা মালগাড়ি দাঁড়ানো। গুদামে পাটের বস্তা পাহাড়ের মতো উঁচু। ওজন করবার কলটা দেখতে যেন বিরাট বিদঘুটে একটা সেলাইয়ের মেশিন। দাঁড়ানো দুটো একটা এই রকম মালগাড়ি যেন পেটে কত দেশবিদেশের রহস্য পুরে চুপ করে আছে। আনু তাদের গায়ে খুব সন্তর্পণে হাত রাখে এত আস্তে, যেন ওগুলো একেকটা মানুষ। আদর করে। বানান করে করে পড়ে গায়ের লেখাগুলো–ই, বি, আর। রেলের গাড়িটার গায়ে লেখা নট টু বি লুজ শান্টেড। মানে বুঝতে পারে না। একটা মালগাড়ির গায়ে সাদা একটা চাকা বসানো—-যেমন মোটর গাড়িতে দেখা যায়। কেউ ওতে হাত দিতে গেছে হয়ত, লাফ দিয়ে তার হাত সরিয়ে দেয় আনু। উত্তেজনায় তার শরীর কাঁপতে থাকে। সে ছাড়া আর কেউ তো জানে না, ওটা হচ্ছে ব্রেকের চাকা। ঘোরালেই ব্রেক খুলে যাবে, গাড়ি তখন ছাড়া পেয়ে হুস্ হুস্ করে ছুটতে থাকবে, সান্তাহার পার্বতীপুর কোথায় চলে যাবে, কেউ থামাতে পারবে না। ছেলেরা অবাক হয়ে সাদা চাকাটা দেখে। কেউ বলে—- যাঃ, ইঞ্জিন না হলে যাবে কী করে? আনু জবাব দেয় গম্ভীর হয়ে, ইঞ্জিনই সব নাকি? বাবার সঙ্গে ইঞ্জিন ছাড়াও গাড়ি দেখেছি কত।