বিলকিসের কথা শুনে আবু বলে, তা কি হয়?
হয় না। হয় না বলেই তো দুঃখ হচ্ছে। যতটুকু হয় না মানুষ মন দিয়ে তা ভরে তুলতে চায় যে।
আবুর তখন ইচ্ছে করে অনেক কথা বলতে। কথা খুঁজে পায় না। চুপ করে থাকে। রিকশা পেলে চলে যায় বিলকিস।
সেদিন রাতে শুয়ে শুয়ে আবু ভাবতে থাকে, বিলকিসের কি কোনদিন অমন মরে যেতে ইচ্ছা করেছে? হয়ত অনেকদিন আগে বিলকিসও অভিমান করে মরে যাবার জন্যে পায়ে পায়ে চলেছে—-যে পথে দুধারে ছিল ঠাণ্ডা ছায়া মেলানো গাছ। আজ এই গাছগুলো দেখে তার মনেও কি ফিরে ফিরে আসতে চেয়েছিল সেই স্মৃতি?
মনে মনে বিলকিসের ছোটবেলা সৃষ্টি করতে থাকে আবু। এত বিশদ করে ভাবতে থাকে। যে, এক সময়ে চোখের সমুখে প্রত্যক্ষ করতে পারে ছোট্ট মেয়েটিকে, যার নাম বিলকিস। এমন একদিন দুদিন নয়, অনেকদিন মনে হয়েছে তার। এমন ক্ষমতা যদি থাকত, যার অলৌকিক বলে সে ফিরে যেতে পারত বিলকিসের শৈশবের পৃথিবীতে, মেলাতে পারত নিজেকে তার সংগে, তার সেই পরিবেশকে করে নিতে পারত নিজের পরিবেশ, তাহলে নতুন সুন্দর জীবন হতো তার। তাহলে ঘর থেকে পা বাড়ালেই দেখা হতো বিলকিসের সংগে। তখন বিলকিসের সংগে পাথরের পথ ভাংগা চলত, বেণি নিয়ে টানাটানি করা যেত, কোচড়ভরা বেতফলে ভাগ বসানো যেত তার।
তা হলে অনেক সহজ হয়ে যেত সব কিছু। সহজ হয়ে যত নিজেকে উন্মুক্ত করা। এমন করে দ্বিধায়, সংকোচে, অভিমানে তাকে জ্বলে পুড়ে মরতে হতো না। তাহলে বুক ভরা বিশ্বাস নিয়ে সে বলতে পারত, তোর কি চোখ নেই, বিলকিস? আমার ভোলা দরোজা দিয়ে আয়। তোর জন্যে খুলে রেখেছি যে।
একদিন, এমনি এক ভাবনার চূড়ান্ত চূড়োয় নিজের চোখে হাত রেখেছিল আবু। সেখানে অশ্রু টলটল করবে, উষ্ণ তরল বিকারহীন অশ্রু, এ যেন তার কতকালের জানা।
আজ হঠাৎ ওভাবে ইউনিভার্সিটি ছেড়ে তার বেরিয়ে পড়বার কারণ ছিল। মনের ভাবনাগুলো রীতিমত সশরীর হয়ে মাথার ভেতরে দুপদাপ লাগিয়েছে তখন থেকে।
বিকেল চারটেয় দেখা হবে বিলকিসের সংগে। এখনো অনেক দেরি তার। কিন্তু অলক্ষিতে কোথায় কোন এক ঘড়িতে যেন ইতিমধ্যেই বিকেল চারটে বেজে গেছে।
মাথার পরে এখনো খাড়া রোদ। পথ দিয়ে এলোপাথারি চলতে চলতে আবু যেন স্পষ্ট শুনতে পায় বিলকিস তাকে দেখে বলছে, এত দেরি করে এলেন?
তখন ও উত্তর করছে, দেরি করে যাবো বলেই দেরি করে এলাম। যদি সত্যি দেরি হয়ে থাকে, ক্ষমা করে দিন।
তার কথা শুনে বিলকিস যেন হাসলো।
আবু ভারতে থাকে, তখন সে বলবে, আপনাদের এখানে এই প্রথম এলাম। ভারী সুন্দর বাসা। আপনাদের নিজের?
হ্যাঁ।
কিছু ফুলগাছ এনে বাগান করুন।
কে করবে?
কেন, আপনি?
আর আমি বাগান করেছি!
বলেই বিলকিস যেন খুব ক্লান্ত এমনি একটা ভঙ্গিতে হাত তুলেই নামিয়ে নেবে। কিন্তু তার চোখ আলোকিত থাকবে এক নামহীন খুশিতে। পরে শুধোবে, আপনার বুঝি বাগান করার শখ?
বলতে পারবে না আবু। কেবল বলবে, কিছুটা।
কী ফুল করেছেন? নিয়ে যাবেন একদিন দেখাতে?
যাবেন? সত্যি যাবেন? কবে বলুন।
তাহলে কাল।
বেশ তো।
তারপর কাল বাগান দেখে ফেরার পথে আবু আচমকা বলবে বিলকিসকে, কখনো ভালোবেসেছেন?
শুনে বিস্মিত হবে বিলকিস। বিস্মিত হয়ে পরকহীন চোখে তাকিয়ে থাকবে তার দিকে। তারপর কম্পিত কণ্ঠে উচ্চারণ করবে, লাজনা হয়ে, অস্পষ্ট মাথা নেড়ে, না, না। আমিও না।
তখন বিলকিসের শরীর স্পর্শ করে আবু বলবে, কী জানি কেন, সারাক্ষণ খুব একা মনে হয়। মনে হয়, কোথায় কে যেন ঐ দিগন্তটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে খুব চেনা চেনা লাগছে। অথচ চিনতে পারি না, কাছে যেতে পারি না। বলতে পারেন কেন এমন হয়?
কী জানি।
তখন বিলকিস সুন্দর একটি স্বর হয়ে উঠবে।
আমি অনুভব করতে পারছি, চোখ ভরে দেখতে পাচ্ছি, আপনি তাকে চিনতে পারছেন না। আপনার মনে তখন খুব ঝড় দিয়েছে। তখন দুহাত বাড়িয়ে সেই দিগন্তে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে কাছে করছেন। আমি আমার দুচোখ ভরে দেখতে পাচ্ছি যে।
তার উত্তরে আবু তাকে দুহাতে জড়িয়ে বলবে, এইতো আমি কাছে করেছি।
হঠাৎ হাতঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে চারটে বাজতে মাত্র দশ মিনিট বাকি। বিলকিসদের বাসায় পৌঁছুতে লাগবে পনেরো মিনিট। চারটে পাঁচে গিয়ে পৌঁছুবে। সেটা হয়ত সময় রক্ষা হলেও শোভন হবে না মোটেই।
চারটে বলেছে বলে চারটেয় পৌঁছুতে হবে? তাতে করে যেন তার আগ্রহটা ধরা পড়ে যাবে। তার চেয়ে এক রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসলো আবু। কিন্তু কী দুর্ভাগ্যক্রমে সে ঢুকেছিল এই দোকানটায়। তার পুরনো বন্ধু কামাল বসে ছিল একগাদা ফাইল টাইল চায়ের ছড়ানো সরঞ্জাম আর সিগারেটের খোলা প্যাকেট নিয়ে। স্কুল ফাইন্যাল থেকে আই, এ, অবধি একসাথে পড়ে আবু এলো ইউনিভার্সিটিতে আর কামাল গিয়েছিল তার বাপের ব্যবসায়। কামাল দুহাত তুলে হৈচৈ একটা কাণ্ড বাধিয়ে বলল, আরে এসো এসো। কতকাল পরে দেখা।
তাকে দেখে, তার কথা শুনে, আবু খুশি হতে পারল না। একটা বিদঘুঁটে পাথর এসে যেন তার পথ আগলে দাঁড়িয়েছে। তবু চেষ্টা করে যতটা প্রীত হওয়া গেল সেটাই যথেষ্ট হলো। কামালের জন্যে। কামাল খুশি হয়ে টেবিল চাপড়ে বলল, চা খাও।
ঘড়ির দিকে তাকাল আবু। তাকিয়ে একটু উসখুস করে উঠল।
আর কিছু?