কিন্তু রিকশা পেয়েও, অর্ধেকটা পথ এসেও, বিলকিসের কাছে যাওয়া হয়নি সেদিন।
একটা রেস্তোরাঁয় বসে খুব দামি ঠাণ্ডা পানীয়ের ফরমাস করেছে। মনে মনে বলেছে, না গিয়ে ভালোই করেছি। বিলকিস যদি চটে যেত, তাহলে চিরদিনের মতো আমার কাছে ওর দুয়ার বন্ধ হয়ে যেত। সেটা তো আরো মর্মান্তিক। তার চেয়ে এই ভালো।
রেস্তোরাঁ সোফায় গা এলিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দেয়, আরেকদিন যাবো। মেলে ধরবো আমার দুহাত। বলব—- দাও, আমাকে দাও।
কিন্তু এ প্রতিজ্ঞাও রক্ষা করা হয়ে ওঠে না। মনের ভেতরে কেবলি সে ফুঁসতে থাকে অক্ষমতার জ্বালায়।
ইউনিভার্সিটির ভিড়ের ভেতরে চোখে পড়ে বিলকিসের মুখ। কিংবা দূর থেকে তার চলে যাওয়ার তরংগ। কিংবা হাসি, অন্য কারো জন্যে অন্য কোন মুহূর্তে। চকিত হতে হয় বিলকিসের কণ্ঠস্বরে। কোন দিন বা হাত মুক্ত রেখে ডান হাতে বই খাতা কোলের কাছে ধরে মাটির দিকে চিবুক নামিয়ে চলে যায় বিলকিস। বিলকিসের একটা শাড়ি শাদা, একটা ময়ূর নীল, একটা সমুদ্র–নীল, একটা আকাশ নীল, একটা শুধু নীলের আভাস, একটা সোনালি। জমিনে ছোট ছোট লাল ফুল তোলা, আর একটা সবুজ–ছায়া–ছায়া পাতায় পাতায় আচ্ছন্ন। সিনেমা হলে একদিন অন্ধকারে সমুখের কাধ চেনা মনে হয়—- আলো জ্বললে বুকে কাপন ওঠে—-বিলকিস। নীলখেত ব্যারাকের রেলক্রসিং–এ মোটর বাঁধা পড়েছে; নীল রং কন্সালের জানালায় বিলকিসকে দেখা যায় বই ওটাতে ওল্টাতে হাই তুলছে। ইউনিভার্সিটিতে সাহিত্য সভায় বিলকিস একটা সরল রেখার মতো দাঁড়িয়ে তুখোড় ইংরেজিতে বক্তৃতা করছে, সমালোচনার ছুরিতে কোণঠাসা করে ফেলছে কোনো আত্মতৃপ্ত, বানানো অনুভূতি সর্ব, খ্যাতিমান তরুণ লেখককে।
একেকটা রূপ যেন বারুদের একেকটা কাঠি। আবুর প্রত্যক্ষ হলেই যেন তীব্র দীপ্তিতে জ্বলে ওঠে। সে আগুনে তখন আর বিলকিসকে দেখা যায় না। আগুনের ভেতর দিয়ে যে বিলকিসকে দেখা যায়, সে আবুর নিজস্ব পৃথিবীতে তারই চেতনার তুলিতে আঁকা।
আর কথা। বিলকিসেব কথাগুলোও যেন হৃদয়ের মধ্যে লাল আগুন ধরাতে জানে।
খুব সাধারণ একটা কথা। বিলকিস হয়ত একদিন বলেছে, আমাদের বাসায় কাল চোর এসেছিল। রাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙলে আমার এমনিতেই ভয় করে। যা ভয় করছিল।
কল্পনার ফুল দল মেলতে থাকে। আবু ভাবে, বিলকিসের হঠাৎ ঘুম ভাঙলে ভয় করে। ভয় পেলে কেমন দেখায় বিলকিসকে? তার যেন মনে হয়, কাল রাতে বিলকিসের সঙ্গে সে শুয়ে ছিলো। চোরের শব্দে ধরমড়িয়ে উঠে বসেছে সে, বিলকিস, আর আবু তাকে জড়িয়ে ধরে বলছে, ভয় কী, ভয় কী, এই তো আমি।
তখন বিলকিসের মুখ আচ্ছন্ন হয়ে গেছে চুলে। তার ভেতর থেকে পৃথিবীর প্রতীকের মতো মুখটাকে আবিষ্কার করে সে তখন যেন চেপে ধরেছে নিজের মুখের সঙ্গে।
কিংবা হয়ত একদিন কথা হচ্ছিল গেটের কাছে বাড়ি যাবার আগে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। মাথার পরে দেখিয়ে বিলকিস বলল, দেখেছেন গাছগুলো?
হ্যাঁ, কেন?
ভারী সুন্দর, না?
আবু তাকায় আকাশের দিকে। সেখানে সবুজ পাতায় সোনার মতো রোদ পড়ে আছে।
বিলকিস বলে, একেক সময় আমার কী মনে হয় জানেন? মনে হয়, পাতায় ছাওয়া এই রাস্তাটা যদি কোন দিন না ফুরাতো। মনে করুন না, পৃথিবীর শেষ অবধি এমনি করে চলে গেছে গাছের পর গাছ। নিচে পীচের রাস্তা। না, না, লাল মাটির রাস্তা। লাল মাটিতে ডালের ছায়া পড়েছে। সেই ছায়ায় মানুষ পথ চলছে।
আকাশের দিকে, গাছের দিকে, ছায়ার দিকে তাকিয়ে বিলকিস কথাগুলো বলে। চোখ দিয়ে তাকে আর মন দিয়ে তার কল্পনাকে অনুসরণ করে আবু। মনের ভেতরে তার সাড়া ভাঙতে থাকে যেন।
অনেক অনেক আগে আবু যখন ছোট ছিল, তখন একেক দিন, কী জানি কেন অভিমান হলে মরে যেতে ইচ্ছে করত। কিন্তু মানুষ মরে যায় কী করে? আট ন বছরের ছেলেটার তা বোঝার কথা নয়। মনে আছে, তখন অভিমানটা বুকে পুষে আবু ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ত পথে। পথের দুধারে ছিল এমনি গাছ আর গাছ। হাঁটতে হাঁটতে পাথরের পথ শেষ হতো। তারপর ধুলো ভাঙা ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা। ধুলোর ভেতর দিয়ে, গাছের কোল ঘেঁষে, কখনোবা দাঁড়িয়ে পড়ে গাছের গায়ে বেয়ে ওঠা একটা লাল পিঁপড়ে মেরে আবু চলে যেত সেই কোন্ দূরে।
একটু একটু করে আকাশটা মায়ের মুখের মতো হয়ে আসছে। মাথার ওপরে বিরাট আমগাছটায় পাখিদের কাকলি শুনে বাসার সমুখে ছেলেদের কোলাহল মনে পড়ে যাচ্ছে। তখন আবু একটা ছায়ায় দাঁড়িয়ে পা দিয়ে ধুলোয় চক্র আঁকতে থাকে। হয়ত হাটবার ছিল। হাটে যাচ্ছে পশারীর দল। তাদের পেছনে পেছনে শহরে ফিরে এসেছে আবু।
বড় হয়ে যখন মনে পড়েছে এই সব চলে যাওয়ার কথা, তখন আবুর মনে হয়েছে, যেখানে সে চলে যেত আসলে সে জায়গাটা আর এ পৃথিবীতে নেই। সেখানে এখন মৃত্যু ছাড়া আর কিছুতেই ফিরে যেতে পারবে না আবু।
সেই আট ন বছর বয়সে এমনি করে কতবার মরে গেছে আবু। মরে গিয়ে আবার ফিরে এসেছে।
বিলকিসের ওই একটা গুণ আবুকে মুগ্ধ করে রাখে। নিজের ভাবনাটাকে সম্পূর্ণ করে, বিশ্লেষণ করে না বলে থামতে জানে না বিলকিস। অন্য কোনো মানুষের ঠোঁটে যে কথাগুলো শুনে মনে হতে পারত, বানিয়ে বলছে, সেই কথাগুলোই যখন বিলকিস বলে তখন তার পেছনে অন্তরকে অনুভব করা যায়।